অস্ত্রনির্ভর ছাত্ররাজনীতি: জিয়া থেকে খালেদা

দিনকাল বাংলাদেশ

পথিক রহমান

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির একটা  গৌরবজ্জ্বল অধ্যায় আছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান, সর্বোপরি আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ- সবক’টি আন্দোলন সংগ্রামেই বাংলাদেশের ছাত্ররা গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো বরাবরই সুস্থ রাজনীতির চর্চা করে এসেছে জন্ম থেকে। যার ফলে এদেশের ছাত্ররাজনীতি কখনই পেশিশক্তি ধারা নিয়ন্ত্রণ হয়নি। ছাত্রসংগঠনগুলো বরাবরই সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চা করে এসেছে। যেখানে অস্ত্রের ঝনঝনানি ছিলো না। এখন ছাত্ররাজনীতির যে অসুস্থ চর্চা সেটা আগে অর্থাৎ ’৬০ বা ’৭০ এর দশকে ছিলো না।

 

নেতার নির্দেশেই দলীয় নেতাকর্মীরা ঝাপিয়ে পড়তেন আন্দোলনে। যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেন। নিজেদের রাজনৈতিক মতবাদ বা মতাদর্শ প্রচার করতেন। নতুনদের দলে টানতেন। ছিলো পড়ালেখার চর্চা। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে প্রত্যেককেই গভীর মনযোগ দিতে হতো পড়ালেখায়। কর্মীরা পড়ালেখা করছেন কি-না, সেটাও খোঁজ নিতেন দলীয় নেতারা। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে যেন হঠাৎ করেই শুরু হয়ে যায় অস্ত্রের ঝনঝনানি। একদল আরেক দলকে ঘায়েল করতে যুক্তি-তর্কের বিপরীতে অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করলো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেন হঠাৎ করেই অস্থিরতা শুরু হলো। হল দখলের রাজনীতি শুরু হলো অনেকটা চর দখলের মতো। যার সবচেয়ে বড় শিকার হলো সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা। শহরের নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় প্রতিদিনই অস্ত্রের গর্জন শুনা যেতো। উচ্চ শিক্ষা ও ভালো লেখাপড়ার আশায় গ্রামগঞ্জ থেকে এসে শহরের ভালো বিদ্যালয়গুলোগুলো বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত দেশে যেসব উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান আছে সেসব প্রতিষ্ঠানের ভর্তি হলেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু শিক্ষার বদলে সবচেয়ে বেশি শিকার হলেন কুলষিত ছাত্ররাজনীতির।

 

কেন, কিভাবে এদেশের সুস্থধারার ছাত্র রাজনীতি কলুষিত হতে শুরু করলো? কে বা কারা এই অসুস্থ ও অস্ত্র র্নিভর ক্যাডারভিত্তিক ছাত্ররজানীতির সূচনা করলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুব বেশি অতীতে যাওয়ার দরকার নেই। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করলে যতদূর মনে পড়ে, এদেশের ছাত্ররাজনীতি কলুষিত হতে শুরু করে ’৭০ এর দশকের শেষে অর্থাৎ আশির দশকের শুরুর দিকে। স্বাধীন বাংলাদেশের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর থেকে মূলত এদেশে অস্ত্র নির্ভর ক্যাডারভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির সূচনা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির রক্তের ওপর দিয়ে ক্ষমতায় আসা সামরিক শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত ও পাকাপোক্ত করতে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে শুরু করেন।

 

প্রাচ্যের অক্সফোর্ট হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের ডেকে নিয়ে হাতে তুলে দেওয়া হয় বই খাতার বদলে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র। আর এই কাজটি শুরু করেছিলেন সামরিক শাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনিই শিক্ষার্থীদের হাতে বই-কলমের বদলে তুলে দিয়েছিলেন আগ্নেয়াস্ত্র। এই কথাটা গত চার দশক ধরে ব্যাপকভাবে চালু আছে। তারপর থেকেই যেন আমাদরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ালেখার বদলে চর্চা শুরু হয় অস্ত্রের ঝনঝনানি।

 

জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর এদেশের বাছাই করা ছাত্রদের নিয়ে একটা নৌবিহার করেন। ‘হিজবুল বাহার’ নামের ওই নৌ বিহারেই ছাত্রদেরকে অস্ত্র নির্ভর ছাত্র রাজনীতির তালিম দেওয়া শুরু হয়। সেই নৌ বিহারেই ওই সময়ে দেশে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা বিপথগামি হন। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছেন গোলাম ফারুক অভি। তার নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। বই, খাতা-কলমের বদলে অভি হাতে পান অস্ত্র। সেই থেকে যে অভির উত্থান শুরু হল এবং অন্ধকার জগতের দিকে তিনি যে পা বাড়ালেন, সেখান থেকে আর ফিরে আসতে পারেননি। তার সঙ্গে সানাউল হক নীরুসহ আরও অনেকেই একই পথের অনুসারী হয়ে এদেশের ছাত্ররাজনীতিকে শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার বদলে অস্ত্র নির্ভর ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতির চর্চা শুরু করেন।

 

সেই যে বিএনপির ছাত্র শাখা ছাত্রদল অস্ত্রনির্ভর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সেই ধারাবাহিকতা তারা আজও লালন ও ধারণ করে আসছে। ছাত্রদল ক্যাডারদের হাতেই এদেশের বহুমেধাবী শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। ছাত্ররাজনীতির নামে অস্ত্র নির্ভর সংগঠন ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের বিজয় মিছিলে হামলা চালিয়েছিল ১৯৮৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। সেই দিন মধুর ক্যান্টিনের সামেন বিজয় মিছিল পৌঁছলে ছাত্রদলের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যান জাসদ ছাত্রলীগ কর্মী কফিল উদ্দিন।

 

সাকিবুন নাহার সনির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে খুন হয়েছিলেন। ২০০২ সালের ৮ জুন টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের দুই গ্রুপে এই গোলাগুলি ঘটনা ঘটে।

 

মেধাবীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে যে ছাত্ররাজনীতির সূচনা করেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্যাডারভিত্তিক সেই ছাত্ররাজনীতি আজও সক্রিয়। বলতে গেলে ছাত্ররাজনীতির সুস্থ ধারাটি ক্ষয়ে গেছে বা যাচ্ছে অস্ত্র নির্ভর আর পেশিশক্তির রাজনীতির কারণে।

 

পিছনের এই গল্পগুলো বলার একটা কারণ আছে। সরকার পতনের আন্দোলনের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র কনভেনশনের ডাক দিয়েছে বিএনপি। ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচীর অংশ হিসেবে এই ছাত্র কনভেশন করতে যাচ্ছে এদেশে জ্বালা-পোড়াও, বোমা মেরে, অগ্নিসংযোগ করে মানুষ হত্যার রাজনীতির জনক সংগঠন বিএনপি। ২০১৩-২০১৪ সালে নির্বাচিত সরকারকে হঠাতে এবং কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের নামে জ্বালা-পোড়াও, অগ্নিসংযোগ আর পুড়িয়ে মানুষ হত্যার এক ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছিল বিএনপি এবং তার জোট শরিক জামায়াতে ইসলামী সহ অন্যরা। এর আগে কখনও বাংলাদেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেনি। বিএনপি-জামায়াত জোটের  সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এবারও সরকার বিরোধ আন্দোলন করছে এই জোট। তবে আশার কথা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত দলটি ও তাদের জোট শরিকরা পুড়িয়ে মানুষ হত্যায় মেতে না উঠলেও সাধারণ মানুষের মনে নানান ভয় ও শঙ্কা। কখন দলটি সাধারণ মানুষের হামলে পড়ে।

 

আন্দোলনের ধারবাহিকতায় বৃহস্পতিবার ঢাকায় যে ছাত্র কনভেনশন হতে যাচ্ছে তাকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মুখে নানারকম কথাবার্তা শুনা যাচ্ছে। অনেকে বলছেন, বিএনপি তো কখনই মেধাবীদের হাতে বই খাতা, কলম তুলে দেয়নি। বরাবরই তারা বিপরীত ধারা অর্থাৎ অস্ত্র নির্ভর ক্যাডার রাজনীতিকেই আশ্রয়প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। তাদের জোট শরিক জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র শাখা ছাত্রশিবিরও একই ধারার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে।

 

রাজনীতি সচেতনরা বলছেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান মেধাবী শিক্ষার্থীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে সন্ত্রাস নির্ভর যে ছাত্ররাজনীতির জন্ম দিয়েছিলেন সেখান থেকে আজও বিএনপি বের হয়ে আসতে পারেনি। বৃহস্পতিবারের কনভেনশনেও বিএনপি ও তার জোট শরিকরা যে জিয়াউর রহমানের পথ অনুসরণ করে ছাত্রসমাজকে সরকার পতনের আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লেলিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দিবে না- তার কোনো নিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে না বা এমন কোনো বার্তাও পাওয়া যাচ্ছে না।দেখার বিষয় সরকার বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ডাকা ছাত্রকনভেনশনে বিএনপি ছাত্রসমাজকে কি বার্তা দেয়।

 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *