মো. জাহিদ হাসান
১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সর্বপ্রথম রেলপথ চালু হয়। দেশের প্রথম এই রেলপথ স্থপিত হয়েছিল চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়া জেলার জগতি পর্যন্ত। পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল ও ১৯৭১ এর স্বাধীনতার পর দেশের বিভিন্ন জেলা পর্যায়ক্রমে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আসে।
সেই যুগের পরে আজ নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। ১০ অক্টোবর ২০২৩ রাজধানী ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত (৮২ কিলোমিটার) আনুষ্ঠানিক রেল চলাচল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যান চলাচল শুরু হওয়ার মোটামুটি এক বছরের মধ্যেই পদ্মাসেতুতে রেল চলাচলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্মোচিত হতে যাচ্ছে নতুন আরেকটি মাইলফলক।
ঐতিহাসিকভাবে রেলপথে চলাচল বাংলার আপামর জনসাধারনের কাছে একটি আস্থা ও আরামপ্রদ ভ্রমন মাধ্যম। তাছাড়া রেলপথ ও রেল পরিবহন পরিবেশবান্ধব, জ্বালানিসাশ্রয়ী, দীর্ঘস্থায়ী ও নিরাপদ। গ্রামীণ অর্থনীতির সুষম উন্নয়ন, বণ্টন ও পুনর্গঠনে রেল পরিবহন ব্যবস্থার গুরুত্ব অনেক। সীমিত সম্পদ, নিম্ন আয়, অধিক জনসংখ্যা ইত্যাদি কারণে রেল পরিবহনকেই দেশে সবচেয়ে যথার্থ মাধ্যম মনে করা হয়। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, আধুনিক উন্নয়নচিন্তার কেন্দ্রীয় বিষয়গুলো হলো দীর্ঘস্থায়ী ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল এই রেল যোগাযোগ।অধিকন্তু, বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে গণপরিবহন হিসেবেও রেলওয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। নিরাপদ, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব, স্থায়ী পরিবহন নেটওয়ার্ক হওয়ায় পদ্মা সেতুর উপর স্থাপিত রেলপথ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগের দ্বার উন্মোচন করবে। যা এই অঞ্চলে টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
পদ্মাসেতু, পদ্মা নদীর উপর বিস্তৃত একটি স্মারক অবকাঠামো প্রকল্প, যা বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি, সংযোগ, নির্ভরতা এবং আশার প্রতীক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। সমগ্র বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তরান্বিত করা বিশেষ করে দীর্ঘকাল অবহেলিত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের টেকসই উন্নয়ন সাধনের প্রধান অনুঘটক হতে যাচ্ছে এই স্বপ্নের সেতু। যার ফলাফল ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছে সমগ্র জাতি। পদ্মা সেতু এই অঞ্চলে যে কয়টি পরিবর্তন আনয়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের রূপান্তরকারী শক্তি হিসাবে কাজ করছে সেগুলো হল- স্থানীয় ও জাতীয় যোগাযোগের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্থানীয় জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নতকরন ইত্যাদি।
যোগাযোগকে পৃথিবীর সব দেশে টেকসই উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বিস্তৃত ও নিরবিচ্ছিন্ন পরিবহন নেটওয়ার্ক অপরিহার্য। নদী ও জলাশয় দ্বারা বেষ্টিত খুলনা, সাতক্ষীরা এবং যশোরের মতো জেলা নিয়ে গঠিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ঐতিহাসিকভাবে তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে আসছে। এই দৃশ্যপট নাটকীয় ভাবে বদলে দিতে চলেছে পদ্মাসেতু। এটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে সরাসরি রাজধানী ঢাকা এবং দেশের বাকি অংশের সাথে সংযুক্ত করেছে। এই নতুন সংযোগের ফলে ভ্রমণের সময়, পরিবহন খরচ এবং লজিস্টিক প্রতিবন্ধকতা হ্রাস পেয়েছে বহুগুনে। যার ফলে পণ্য, পরিষেবা এবং মানুষের যাতায়াত সহজতর হয়েছে। উন্নত যোগাযোগ সৃষ্টি করছে নতুন বাজার, তরান্বিত করছে বিনিয়োগ আকর্ষণ যার ফলে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য উন্মচিত হচ্ছে সুযোগ আর সম্ভবনার অবারিত দুয়ার। টেকসই উন্নয়নে পদ্মা সেতু যেসব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তা হল আঞ্চলিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা। বাংলাদেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলে কৃষি, শিল্প, পর্যটনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। পর্যাপ্ত পরিবহণ পরিকাঠামোর অভাব এতদিন এই সুযোগগুলিকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।
পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উর্বর সমভূমি থেকে কৃষিপণ্য শহুরে বাজারে দ্রুততার সাথে কম খরচে পরিবহন করার পাশাপাশি শিল্প খাতকেও সম্প্রসারিত হতে অন্যতম উদ্দীপক হিসাবে কাজ করছে।এর ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, দারিদ্র্যতা হ্রাস পাবে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।উপরন্তু, পর্যটন শিল্পে পদ্মা সেতুর প্রভাব ছোট করা যাবেনা। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভবন এবং স্নিগ্ধ নদী বেষ্টিত দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। পদ্মা সেতু নিশ্চিতভাবে এই আকর্ষণগুলোকে পর্যটকদের জন্য আরও সহজে ভ্রমনযোগ্য করে তুলবে, সম্ভাব্য পর্যটকদের আগমন বাড়াবে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে।
টেকসই উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। পদ্মা সেতুর সরাসরি প্রভাব পড়বে দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন- জীবিকার ওপর। এটি দৈনিক যাত্রীদের জন্য ভ্রমণের সময় হ্রাস করবে, তাদের জন্য ঢাকা এবং অন্যান্য নগর কেন্দ্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগগুলি সহজতর করবে। তদুপরি, সেতুটি গ্রামীণ কৃষক এবং বাসিন্দাদের জন্য বাজার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা সুবিধা আরও সহজলভ্য হওয়ায় মানুষের স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্তির সুযোগ বাড়বে বহুলাংশে।
পদ্মা সেতু ও তার সাথে সম্প্রতি নির্মিত রেল সংযোগের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সড়ক নেটওয়ার্ক, রেলসংযোগ এবং অন্যান্য সহায়ক সুবিধা। এই অবকাঠামোগত উন্নয়নগুলি এই অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে, যা কিনা ব্যবসা এবং বিনিয়োগের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নে ঐতিহাসিক বৈষম্য মোকাবেলা করতে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করবে। এর ফলে, আঞ্চলিক বৈষম্য কমবে এবং সম্পদ ও সুযোগের আরও সুষম বণ্টনে অবদান রাখবে এই সেতু।
পদ্মা সেতু দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চল তথা সমগ্র বাংলাদেশের জনগণের জন্য আশা ও সুযোগের আলোকবর্তিকা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, একটি উজ্জ্বল এবং আরও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করছে। এ সেতু নির্মাণকে ঘিরে দেশে ও বিদেশে হয়েছে নানা ষড়যন্ত্র, প্রকল্প শুরুর আগেই দেয়া হয় দুর্নীতির কলঙ্ক। সেই অজুহাতে মুখ ফিরিয়ে নেয় বিশ্বব্যাংক। কিন্তু বাংলাদেশ থেমে থাকেনি, দমে থাকেনি। থেমে থাকেননি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন এবং তা বাস্তবায়ন করে দেখান। এভাবেই শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্তে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ, এগিয়ে যাবে, হবে সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা। অব্যাহত থাকুক এই ধারা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।