বিশেষ প্রতিনিধি
ট্রেনের কামরায় দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। ভিতরে স্ত্রী-সন্তান পুড়ছে। জানালার বাইরে নিজের দুই হাত আর মুখ বের করে স্ত্রী-সন্তানকে বাঁচানোর আকুল আকুতি জানাচ্ছেন এক হতভাগ্য বাবা। স্ত্রী-সন্তানকে বাঁচাতে না পারলে নিজেও বাঁচার কোনো ইচ্ছে নেই। শেষ পর্যন্ত পুরো পরিবারের অন্তিম যাত্রা ঘটলো।
বাবাকে শেষ বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী। সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে বাবাকে শুইয়ে দিয়ে ঢাকায় স্বামীর কাছে নিজের শিশু সন্তান আর ছোট ভাই ও তার স্ত্রীকে নিয়ে ফিরছিলেন এলিনা চপল। শিশু সন্তান আর ছোট ভাই ও তার স্ত্রী বের হতে পারলেও এলিনা পারলেন না নিজেকে রক্ষা করতে। মৃত্যুই হলো তার শেষ ঠিকানা।
এই দুটি ঘটনাই শুক্রবার রাতের। রাজধানীর পোস্তগোলায় বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এভাবেই করুণ মৃত্যু ঘটেছে এলিনা এবং নাম পরিচয়হীন যুবক ও তার স্ত্রী-সন্তানের। দ্বগ্ধ হয়েছে আরও অনেকে। এদের মধ্যে শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন আট জনের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। এরমধ্যে আছে দুই শিশুও।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, জনরাজনীতি থেকে যোজন যোজন দুরে ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি উম্মাদ হয়ে গেছে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে সেটি ঠেকানোর নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছে। এটি ঠেকাতে সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন তারা।
তারা বলছেন, গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে বিএনপি-জামায়াত জোট ও সমমনা দলগুলো দেশ জুড়ে হরতাল-অবরোধ ডেকে নারকীয় তাণ্ডবে মেতে উঠেছে। প্রতিটি হরতাল-অবরোধের আগে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ট্রেন, বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কারসহ গণপরিবহণে অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে একটা ভীতিকর অবস্থা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।
গত দুই মাসের বেশি সময়ে সারাদেশে তিন শতাধিক যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হরতাল-অবরোধ আহবান করে অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে যে মরণ খেলায় মেতে উঠেছে তার শেষ পরিণতি খুবই ভয়াবহ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি নিজেরাই নিজেদেরকে আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছে। একের পর এক নাশকতার ঘটনা ঘটিয়ে দলটি শুধৃ নৃশংসতার জন্ম দিচ্ছে। বহু পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। বিএনপির আগুনে পুড়ে ছারখার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই বিএনপির।
সহিংসতার পথ পরিহার না করলে এদেশের রাজনীতিতে মুসলিম লীগের পরিণতি হবে বিএনপির- এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘এটা স্পষ্ট বুঝাই যাচ্ছে যে, ট্রেনে আগুন দেওয়া ঘটনা মূলত মানুষকে ভোট কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করা। মানুষ যেন শহর থেকে না যেতে পারে। এ কারণেই এই আগুনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এসব ঘটনা বন্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স দেখানো দরকার। জঙ্গিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যেভাবে সরকার জিরো টলারেন্স দেখিয়েছে সেভাবে জিরো টলারেন্স দেখালে তখন আর কেউ এগুলো করবে না। ঘটনা তদন্ত করে যার জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এর আগের ঘটনায় তো দায়িদের চিহ্নিত করা গেছে।’
তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে ট্রেনের ভিতরে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগোনো যেতে পারে। যেহেতু এখন টেকনোলজি আছে সুতরাং এগুলো না লাগানোর কোনো কারণ নেই। এটা করার মাধ্যমে এসব ঘটনাকে একেবারে জিরোতে নিয়ে আসা যাবে।
ড. ইমতিয়াজ বলেন, একজনের মৃত্যুও কাম্য নয়, কিন্তু আমরা যদি আগের নির্বাচনগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখবো এরচেয়ে বেশি সহিংসতা, সংঘর্ষ হয়েছে। সেই তুলনায় এখন অনেক কম। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে চার সপ্তাহে দেশে ১৫০ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ বলেন, নিঃসন্দেহে বিএনপির রাজনীতি হতাশার মধ্যে পড়েছে। খাদের মধ্যে পড়েছে। এর কারণ হলো বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেই হবে। নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে রাজনীতির সক্ষমতা বা সৎসাহস তাদের নেতৃত্বের মধ্যে আমরা দেখিনি। এ কারণে তারা নির্বাচন বর্জন করেছে। বর্জন করার আগে আমরা যেটা দেখেছি সেটা হচ্ছে তারা একটা বিদেশ নির্ভর রাজনীতি করেছে। বিদেশী হস্তক্ষেপ এমন প্রভাব বিস্তার করলো যে, তাদের ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে একটি সুযোগ তৈরি করলো। তাদের এই বিদেশ নির্ভর রাজনীতি যতোই ফোকাস হয়েছে ততোই তারা গণমানুষের কাছ থেকে দূরে চলে গেছে, বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ফলে তাদের নেতৃত্বের প্রতি নেতাকর্মীদের আস্থা কমেছে। প্রবাস থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার যে প্রবণতা আমরা দেখছি সেটির উপরে দলের ভিতরে দলের নেতাকর্মীদের আস্থা কমেছে। অর্থাৎ তারেক জিয়ার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
আবদুর রশিদ বলেন, নির্বাচন বর্জন করার জন্য যে পরিমান জনসমর্থন তারা পক্ষে আনার কথা সেই পরিমান জনসমর্থন তারা পক্ষে আনতে সক্ষম হয়নি বলে অনুমিত হচ্ছে। যার ফলে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ এবং জনসমর্থনের সংকট থেকে তারা নির্বাচন প্রতিহত করার রাস্তা বেছে নিয়েছে। এজন্য তারা গুপ্ত হামলা বা হঠাৎ করে হামলা করে জনমানুষকেভিীতি প্রদর্শন করে ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য এই বাধা সৃষ্টি করতে চায়।
বাস-ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ হত্যার বিষয়ে মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান বলেন, বাস,ট্রেনে আগুন দিয়ে যারা মানুষ হত্যা করে, প্রেটোল বোমা নিক্ষেপ করে, রেল লাইন উপড়ে ফেলার মত কাজ যারা করে তারা নামে মুসলিম হলেও কোরআনের ভাষায় তারা মুনাফিক।
তিনি আরও বলেন, জনগণকে যারা বড় বড় স্বপ্ন দেখিয়ে মাঠে নামায়, ভাঙচুর করায়, এর সমস্ত ক্ষতিকর দিক সাধারণ জনগণকেই ভূগতে হয়।