বহু বছর নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রাখার পর অবশেষে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবী যখন স্নায়ুযুদ্ধে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, তখনও নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রেখেছিল উত্তর ইউরোপের এই দুই দেশ। কোনও সামরিক জোটে তারা যোগ দেয়নি। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর সেই পরিস্থিতির বদল হয়েছে। যদিও যুদ্ধ ন্যাটোর পূর্ব সীমান্তে হচ্ছে, কিন্তু ইউরোপের যেসব দেশ ন্যাটোর সদস্য হয়নি, তাদের মধ্যেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, তারাও রাশিয়ার আক্রমণের শিকার হতে পারে।
এরপরই ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আগ্রহের কথা জানান। যদিও সুইডেনসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর জনগণের মধ্যে ন্যাটোর সামরিক জোটে যোগদানের জন্য কখনওই খুব বেশি সমর্থন ছিল না।
কিন্তু যখন রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সম্প্রতি ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে স্পষ্টভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, ন্যাটোর সদস্য হওয়ার দিকে তাদের যেকোনও পদক্ষেপের পরিণতি হতে পারে সামরিক, তখন উভয় দেশের মানুষ গভীরভাবে মর্মাহত হয়। তারপর থেকে, রুশ যুদ্ধবিমান নির্বিচারে সুইডিশ আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ করেছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার একটি সাবমেরিনও প্রবেশ করেছিল স্টকহোমের সীমানায়।
নিরপেক্ষ থাকা যদি রাশিয়ার কাছ থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য যথেষ্ট না হয়, তবে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের জনগণ বলছে- হয়তো ন্যাটোতে যোগ দিলে দেশ দুটি প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পেতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার কাছে নিজেদের ১০ শতাংশ ভূমি হারালেও কোনও জোটে যোগ দেওয়া থেকে বিরত ছিল ফিনল্যান্ড।কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড উত্তর ইউরোপের দেশগুলোকে আশঙ্কায় ফেলে দেয়। ফলে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলো নিজেদের অনিরাপদ ভাবতে শুরু করে।
ফিনল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার স্টাব বলেছেন, ২৪ ফেব্রুয়ারি যখন রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করে, সেদিনই ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া হয়ে গেছে। গত নভেম্বরেও সুইডেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার হলৎভিস্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে সুইডেন কখনওই ন্যাটোতে যোগ দেবে না। কিন্তু সেই বক্তব্য থেকে ফিরে আসেন তিনি। ন্যাটোতে যোগ দিতে এখন মরিয়া তার দেশ। কেননা, এতে নরডিক দেশগুলোর নিরাপত্তা আরও জোরদার হবে।
অনেকে ফিনিশ এবং সুইডিশ মনে করেন, ইউরোপে এখন যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, ন্যাটোতে যোগ দিলে তা থেকে তারা সুরক্ষা পাবেন। তবে কম হলেও ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার বিপক্ষে মনোভাবও রয়েছে একটি অংশের।
সুইডিশ পিস অ্যান্ড আরবিট্রেশন সোসাইটির সদস্য ডেবোরা সলোমন বলেছেন, ন্যাটোয় যোগ দিলে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক উত্তেজনা আর ঝুঁকি বাড়বে। সেই সঙ্গে বিশ্বে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ আন্দোলনে সুইডেনের যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রয়েছে, তা হারাতে হবে।
ন্যাটোয় যোগ দিলে বিশ্বে শান্তি রক্ষায় সুইডেনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও আর থাকবে না। ফিনল্যান্ডের দিক থেকে দেখতে গেলে, ইউক্রেন আক্রমণের সাথে ১৯৩৯ সালের ফিনল্যান্ড আক্রমণের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে- যা দেশটিতে শীতকালীন যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ জোসেফ স্তালিন তার সেনাবাহিনীকে ফিনল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন শুধুমাত্র এটা প্রমাণ করতে যে, জেনারেলরা তাকে যে ধারণা দিয়েছিলেন তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা আসলে তার চেয়েও শক্তিশালী।
ফিনল্যান্ডের জনগণ তখন বিশাল এক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। ওই বাহিনীর মনোবল এক বছর বা তারও আগে গুরুতরভাবে ভেঙে পড়েছিল। ওই বাহিনীর বেশিরভাগ শীর্ষ ব্যক্তিত্বের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে।
আলোচনা শুরু হওয়া এবং একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর আগে ‘শীতকালীন যুদ্ধ’ কয়েক মাস ধরে চলেছিল।সেসময় রাশিয়া ফিনল্যান্ডের কাছ থেকে কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। কিন্তু ফিনিশরা তাদের স্বাধীনতা হারায়নি- এবং তখন থেকে তারা এটি এখনও ধরে রেখেছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা