ফয়সাল খলিলুর রহমান
আমি যখন যতবারই টুঙ্গিপাড়া গিয়েছি, গ্রামটাকে ঠিক গ্রামই মনে হয়েছে। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান কিংবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মস্থান হলেও টুঙ্গিপাড়ায় তেমন বড় কোন ভবন নেই। খাল-বিলের জলের কিনারায় হিজল করচে ঘিরে থাকা বাংলার আদিম জনপদ যেন টুঙ্গিপাড়া। শেখ হাসিনা তাঁর ছোটবেলার কথা উঠলেই টুঙ্গিপাড়ার গ্রামের কাঁচা রাস্তায় সমবয়সীদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর গল্প বলেন। মাছ ধরার জাল ‘ওচা’ দিয়ে তিনি গ্রামের অন্য বাচ্চাদের সাথে মাছ ধরতেন। গাছে উঠা, সাতার কাঁটা, অন্যের গাছ থেকে কাঁচা আম পেড়ে খাওয়ার মতো দুরন্তপনা শৈশব ছিলো তাঁর। শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেগুলো ছিল আমার জীবনের সেরা সময়’।
বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তানের মাঝে শেখ হাসিনা ছিলেন সবার বড়। বড় সন্তানদের হতে হয় সমুদ্রের মতো বিশাল। পরিবারের বড় বড় দায়িত্বগুলো বড় সন্তানের কাঁধে এসে জুটে। বিভিন্ন লেখায় ছোট ভাই বোনদের প্রতি তাঁর পরম স্নেহের কথা আমরা বারবার পড়েছি। বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব কিভাবে আটপৌরে জীবন যাপন করেন, তা আমরা শেখ হাসিনাকে দেখে শিখি। ক’দিন আগেও আমরা তাঁকে টুঙ্গিপাড়ায় ভ্যানে চড়ে গ্রাম ঘুরতে দেখেছি। আবার সারা বিশ্বের তাবৎ পরাক্রমশালী নেতাদের সাথেও শেখ হাসিনাকে আমরা চোখে চোখ রেখে কথা বলতে দেখতে পাই। কমনওয়েলথ সম্মেলনে প্রয়াত ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ বাকিংহাম প্যালেসে শেখ হাসিনাকে খুঁজে না পেয়ে বলেছিলেন, “হাসিনা কোথায়, ওকে দেখছি না কেন!” বলাবাহুল্য বাংলাদেশ এখন সারা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। টুঙ্গিপাড়ার ‘আলসেখানা’র সেই সাধারণ মেয়েটি কীভাবে এক পৃথিবী শোক কাটিয়ে, শত্রুর সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, বারবার ঘাতকের গ্রেনেড ও বুলেট এড়িয়ে, অন্ধকারের অতল গহ্বরে থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আলোর পথে নিয়ে আসলেন। কেমন ছিলো তাঁর এই পথচলা?
স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বিশ্বস্ত সহচর, অকৃত্রিম সুহৃদ তাজউদ্দীন আহমদ কিছুটা ষড়যন্ত্রে, কিছুটা অভিমানে দূরে সরে গেলে বঙ্গবন্ধু ব্যথিত হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা পিতাকে কিছুটা সান্তনার সুরে একদিন বলেছিলেন, মোশতাক কাকা তো আছেন। বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন, তুই মোশতাককে চিনিস? ও যে কোনো সময় আমার বুকে ছুরি চালিয়ে দেবে। সত্যিই সত্যিই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী আর্মিদের বুলেটে ক্ষত বিক্ষত হয় বঙ্গবন্ধুর হিমালয় সমান শরীর। মোশতাক গংরাও বসে যায় ক্ষমতার মসনদে।
শেখ হাসিনার স্বামী প্রতিথযশা বিজ্ঞানী এম. ওয়াজেদ মিয়ার গবেষণার কারণে পঁচাত্তরের ৩০ জুলাই জার্মানিতে যান শেখ হাসিনা; তার সঙ্গে ছোট বোন শেখ রেহানাও সেখানে যান বেড়াতে। ১৫ আগস্ট তারা সবাই ছিলেন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায়। এদিন সকালে তাদের প্যারিস যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আগের দিন (১৪ আগস্ট) গাড়ির দরজায় ড. ওয়াজেদ মিয়ার হাতে চাপা লাগে, ফলে তারা ওই অবস্থায় প্যারিসে যাবেন কি না, এ নিয়ে ভাবছিলেন। ১৫ আগস্ট ভোর ৬টার দিকে ওয়াজেদ মিয়ার ঘুম ভাঙে সানাউল হকের স্ত্রীর ডাকে। জার্মানির বন থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী ফোন করেছেন, তিনি জরুরি কথা বলতে চান ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার জন্য ওয়াজেদ মিয়া স্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাঠিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর শেখ হাসিনা ফিরে এসে জানান, হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চান। টেলিফোন ধরতে ওয়াজেদ মিয়া দ্রুত নিচে নামেন। তখন সেখানে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা নিচু করে পায়চারি করছেন সানাউল হক। ওয়াজেদ মিয়া ফোন ধরতেই অন্যপ্রান্ত থেকে রাষ্ট্রদ‚ত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘আজ ভোরে বাংলাদেশে ক্যু হয়ে গেছে। আপনারা প্যারিস যাবেন না। রেহানা ও হাসিনাকে এ কথা জানাবেন না। যতদ্রুত সম্ভব আপনারা সবাই আমার এখানে চলে আসুন।’
সানাউল হক যখন শুনলেন ঢাকায় সেনা বিদ্রোহ হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন, সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি শেখ হাসিনা, রেহানা এবং ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বৈরী আচরণ শুরু করেন এবং কোনো প্রকার সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি সবাইকে যত দ্রুত সম্ভব বাসা থেকে চলে যেতে বলেন। বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য গাড়িটা পর্যন্ত দিতে অস্বীকৃতি জানান। যদিও বঙ্গবন্ধু এই সানাউল হককে রাজনৈতিক বিবেচনায় বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর ওয়াজেদ মিয়া যখন বাসার ওপরে যান তখন শেখ হাসিনা অশ্রুজড়িত কণ্ঠে ওয়াজেদ মিয়ার কাছে জানতে চান হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীর সঙ্গে তার কী কথা হয়েছে। ওয়াজেদ মিয়া জানান, রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তাদের প্যারিস যাত্রা বাতিল করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জার্মানির বনে ফিরে যেতে বলেছেন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দুজনই কাঁদতে কাঁদতে বলেন, নিশ্চয়ই কোনো দুঃসংবাদ আছে যেটি ওয়াজেদ মিয়া তাদের বলতে চাইছেন না। আর তখন তারা দুজন বলেন, প্যারিসের যাত্রা বাতিল করার কারণ পরিষ্কারভাবে না বললে তারা বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না। বাধ্য হয়ে ওয়াজেদ মিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশে কী একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে, এ জন্য আমাদের প্যারিস যাওয়া যুক্তিসংগত হবে না।’ এ কথা শুনে তারা দুই বোন কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের কান্নার শব্দে শেখ হাসিনার সন্তান জয় ও পুতুলের ঘুম ভেঙে যায়।
পাকিস্তান-মার্কিন চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার যে ‘ব্লু-প্রিন্ট’ তৈরি করেছিল, এর বাইরে ছিলেন না তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ওই সময় তারা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ওইদিন তারা ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পেলেও বিদেশে তাদের হত্যা করতে চক্রান্তকারীদের ‘প্ল্যানিং সেল’ ছিল বেশ তৎপর। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অন্যরকম একটি জীবন শুরু হয়। পিতামাতাসহ গোটা পরিবার হারিয়ে একটি সংগ্রামী যাত্রায় যেনো নেমেছেন এই দুই বোন। চারদিকের শত্রু গিজগিজ করছে, সুযোগ পেলেই তাঁদের হত্যা করা হবে। পিতা শেখ মুজিবকে হত্যার পর পৃথিবীর কোথাও যেন তাদের জায়গা হচ্ছিলো না। শেষপর্যন্ত তাঁরা কোনও মতে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদ‚ত হুমায়‚ন রশিদ চৌধুরীর কাছে পৌঁছেছিলেন। সেখানে যাওয়ার আধঘণ্টার মধ্যেই যুগোস্লাভিয়া সফরে আসা বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেনও সেখানে পৌঁছান।
বিবিসি হিন্দি’র রেহান ফজলের প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি মার্শাল টিটো শেখ মুজিবের দুই কন্যা ও জামাতার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ফোন করেছিলেন। কিন্তু এরপরে তাঁরা কোথায় থাকবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছিল না। হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীর পুত্র নোমান রশিদ চৌধুরী ২০১৪ সালের ১৫ই অগাস্ট একটি জাতীয় পত্রিকায় ‘বঙ্গবন্ধু’জ ডটার্স’ (বঙ্গবন্ধুর কন্যারা) শিরোনামের একটি লেখায় স্মৃতিচারণ করেছেন এই ভাবে, “পশ্চিম জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ওয়াই কে পুরীর সঙ্গে আমার বাবার দেখা হয়েছিল একটা ক‚টনৈতিক অনুষ্ঠানে। তিনি মি. পুরীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে ভারত কি শেখ হাসিনা আর তাঁর পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারবে কি না? তিনি খোঁজ নিয়ে জানাবেন বলেছিলেন। পরের দিন মি. পুরী আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে তাঁর দপ্তরেই চলে আসেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল ও সময়সাধ্য। তিনিই বলেন, দিল্লিতে তো বাবার নিজেরই অনেক চেনাশোনা, কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে সেখানে মিশন প্রধান ছিলেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধী আর তাঁর দুই পরামর্শদাতা ডি পি ধর এবং পি এন হাক্সর তো বাবাকে বেশ পছন্দ করেন। তাঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন মি. পুরী। তাঁর সামনেই মি. চৌধুরী ডি পি ধর এবং পি এস হাক্সরকে ফোন করেন। কিন্তু দুজনেই সেসময় ভারতের বাইরে। সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীকে ফোন করতে মি. চৌধুরী একটু ইতস্তত করছিলেন। মিসেস গান্ধী একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী আর মি. চৌধুরী একজন সাধারণ রাষ্ট্রদ‚ত। মিসেস গান্ধীর সঙ্গে তাঁর কয়েকবার সাক্ষাত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বছর তিনেক তাদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিলনা। রাজনীতিতে তিন বছর অনেকটা লম্বা সময়। আর তারও পরে তখন ভারতে জরুরী অবস্থা চলছে। মিসেস গান্ধী নিজেই ব্যতিব্যস্ত।” নোমান রশিদ চৌধুরী লিখেছেন, “যখন কোনও দিক থেকেই কিছু হচ্ছিল না, তখন একরকম শেষ চেষ্টা করে দেখার জন্য বাবা মিসেস গান্ধীর দপ্তরে একদিন ফোন করেই ফেললেন। ঘটনাচক্রে সেই ফোনটা ইন্দিরা গান্ধী নিজেই তুলে ছিলেন। বাবা মিসেস গান্ধীকে গোটা বিষয়টা খুলে বললেন। তক্ষুনি বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজী হয়ে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।”
জার্মানিতে ভারতের রাষ্ট্রদূত মি. পুরী ১৯ আগস্ট হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীকে জানিয়েছিলেন যে দিল্লি থেকে নির্দেশ এসেছে শেখ মুজিবের দুই কন্যা এবং তাঁদের পরিবারকে খুব দ্রুত সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে । এদিকে ব্যাথা-বেদনায়, সন্দেহ-অনিশ্চয়তায় জর্জরিত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীকে ঘরের বাইরে নিয়ে ওয়াজেদ মিয়া ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। নিরাপদ স্থানে না পৌঁছানো পর্যন্ত শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে কোনো কিছু জানানো হবে না, এ শর্তে হুমায়‚ন রশিদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে বলেন, ‘বিবিসির এক ভাষ্যানুসারে রাসেল ও বেগম মুজিব ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত এক বিবরণীতে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ বেঁচে নেই।’ ২৩ আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়াকে টেলিফোন করে জানান, ভারতীয় দ‚তাবাসের একজন ফার্স্ট সেক্রেটারি তাদের সঙ্গে দেখা করবেন। সেদিন দুপুর ২টার দিকে ওই কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে দেখা করে বলেন, পরের দিন অর্থাৎ ২৪ আগস্ট সকাল ৯টায় তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা ২৪ আগস্ট তাদেও ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তবে তাদের গন্তব্যের বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়।
এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে ২৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টার দিকে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান শেখ রেহানা, শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান জয় ও পুতুল। ভারতীয় মন্ত্রিপরিষদের একজন যুগ্ম সচিব তাঁদের স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে হাজির ছিলেন। প্রথমে ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি ‘সেফ হাউস’-এ তাঁদের রাখা হয়েছিলো। পরে ডিফেন্স কলোনির একটি বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। দশ দিন পর, ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ভারতের বৈদেশিক গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা ‘র’-এর একজন কর্মকর্তা তাঁদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আবাস ১ নম্বর সফদরজং রোডে পৌঁছান। দেখা হওয়ার পরে ইন্দিরা গান্ধীকে শেখ হাসিনা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “১৫ই অগাস্ট ঠিক কী হয়েছিল?” সেখানে উপস্থিত একজন অফিসার শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, তাঁর পরিবারের আর কেউ জীবিত নেই। এটা শুনেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার জীবনীকার সিরাজউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, “ইন্দিরা গান্ধী হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তোমার যা ক্ষতি হয়েছে, তা তো পূরণ করা যাবে না। তোমার তো এক ছেলে, এক মেয়ে আছে। আজ থেকে ছেলেকে নিজের বাবা আর মেয়েকে নিজের মা বলে মনে করো।”
ভারতীয় সরকারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ইন্ডিয়া গেটের কাছে পান্ডারা পার্কের সি ব্লকে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছিলো। ওই ফ্ল্যাটে তিনটি বেডরুম আর কয়েকটি আসবাবপত্র ছিল। পরে তিনি নিজেই কিছু কিছু আসবাব কিনেছিলেন। তাঁর ওপর কড়া নির্দেশ ছিল যে, তিনি যেন ঘরের বাইরে না যান, অথবা কারও সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ না করেন। তাদের ঘরে একটা টেলিভিশন সেট দেওয়া হয়েছিলো। তৎকালীন সময়ে ভারতের টেলিভিশনে শুধুমাত্র দু’ঘণ্টার জন্য দূরদর্শনের অনুষ্ঠান প্রচারিত হত। তবে তাদের বাড়িতে কোনো টেলিফোন সংযোগ দেওয়া হয়নি। ‘র’-এর একজন প্রাক্তন অফিসার নাম না প্রকাশের শর্তে বলছিলেন, “শেখ হাসিনার নিরাপত্তার জন্য দু’জনকে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সত্য ঘোষ নামের এক ইন্সপেক্টর। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাঁকে নিয়ে আসা হয়। অন্যজন ছিলেন ১৯৫০ সালের ব্যাচের ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস অফিসার পি কে সেন। ঘটনাচক্রে ইন্সপেক্টর সেনকে ‘কর্নেল’ হিসাবে, আর পদাধিকার বলে তাঁর থেকে অনেক উঁচুতে, আইজি র্যাঙ্কের অফিসার পি কে সেনকে ‘ইন্সপেক্টর’ হিসাবে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে রাখা হয়েছিল। এই দু’জন অফিসারই ছায়ার মতো শেখ হাসিনা পরিবারের সঙ্গে থাকতেন।
শেখ হাসিনার স্বামী ডক্টর ওয়াজেদ মিয়াকে ১৯৭৫ সালের ১লা অক্টোবর ভারতের পরমাণু শক্তি বিভাগে ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছিলো। ‘র’-এর ওই প্রাক্তন কর্মকর্তা বলছিলেন, “শেখ হাসিনার সব খরচ ভারত সরকারই দিত। যদিও সেটা খুব সামান্যই ছিল। টাকাটা কলকাতায় তাঁর এক পরিচিত চিত্তরঞ্জন সুতারের মাধ্যমে দেওয়া হত।” শেখ হাসিনা যে দিল্লি আছেন, সেই খবরটা ভারতীয় সরকার গোপন রাখতেই চেয়েছে। তবে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার তাঁর অবস্থান জেনে গিয়েছিলো। ১৯৭৬ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রদ‚ত শামসুর রহমান আর তাঁর স্ত্রী দেখা করতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানার সঙ্গে। দুই বোন তাঁদের দেখে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছিলেন।
শেখ রেহানার সে বছরই দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনাবলীর জন্য তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে শান্তিনিকেতনে তাঁর ভর্তিও ব্যবস্থা হয়েছিলো। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়। ২৪শে জুলাই, ১৯৭৬ – শেখ রেহানার বিয়ে হয় লন্ডন-প্রবাসী শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে। যদিও শেখ হাসিনা এবং তাঁর স্বামী ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি।
শেখ হাসিনা পরিবারের ভারতের প্রবাস জীবনে প্রণব মুখার্জী গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ইন্দিরা গান্ধী সরকারের মন্ত্রী প্রণব মুখার্জী এবং তাঁর পরিবার শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক রাখতেন। শেখ হাসিনার সন্তানদের মাঝেমাঝেই মি. মুখার্জীর সরকারি বাসভবনে খেলতে দেখা যেত। নিজের বই ‘ড্রামাটিক ডিকেড’-এ মি. মুখার্জী স্মৃতিচারণ করেছেন যে দুটি পরিবারের মধ্যে মাঝে মাঝে শুধু দেখাই হত না, দিল্লির বাইরে পিকনিকেও যাওয়া হত।
এরই মধ্যে ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে হেরে গেলেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই “র”-এর কাজকর্মে খুব একটা আগ্রহ দেখাতেন না। এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এ লিখেছেন, “রেহানাকে দিল্লিতে আসার ব্যাপারে কথা বলার জন্য শেখ হাসিনা ১৯৭৭ সালে মোরারজী দেশাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। শেখ রেহানাকে দিল্লি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন মি. দেশাই। রেহানা ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দিল্লি এসেছিলেন। পান্ডারা পার্কের ফ্ল্যাটে শেখ হাসিনার সঙ্গেই ছিলেন তিনি।” তবে ধীরে ধীরে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার ব্যবস্থা থেকে হাত গোটাতে শুরু করেছিলেন মোরারজী দেশাই। সেই সঙ্গে ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনার ওপর একরকম চাপ তৈরি করা হয়, যাতে তারা নিজেরাই ভারত ছেড়ে চলে যান। প্রথমে তাদের ফ্ল্যাটের বিদ্যুৎ বিল দেয়া বন্ধ করা হয়। তারপর গাড়ির ব্যবস্থাও তুলে নেওয়া হয়। ডক্টর ওয়াজেদ নিজের ফেলোশিপটা এক বছর বাড়ানোর আবেদন করেন। প্রায় তিন মাস এর কোনো জবাব আসেনি। সে কারণে তাকে বেশ আর্থিক সমস্যায়ও পড়তে হয়। তবে ১৯৮০-র জানুয়ারিতেই ইন্দিরা গান্ধী আবারও ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন। সেই সাথে শেষ হয়েছিল শেখ হাসিনার সব দুশ্চিন্তা। সে বছরই ৪ঠা এপ্রিল শেখ হাসিনা নিজের সন্তানদের নিয়ে লন্ডনে যান রেহানার সঙ্গে দেখা করতে।
দিল্লিতে কাটানো পৌনে ছয় বছরে মানসিকভাবে শেখ হাসিনা ছিলেন অত্যন্ত বিপর্যস্ত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার পরিবারের সিংহভাগ সদস্যের সঙ্গে যা হয়েছিল, তা মেনে নেয়া শেখ হাসিনার জন্য ছিল অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। সেদিনের স্মৃতি বিভীষিকার মতো তাড়া করে বেড়াচ্ছিল তাকে। এমনকি ১৫ আগস্টের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উল্লেখও ছিল শেখ হাসিনার জন্য বড় ধরনের ট্রিগার। তাই তাঁর স্বামী ওয়াজেদ মিয়া তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা সকলকে বিশেষভাবে অনুরোধ করতেন, তার সামনে যেন ১৫ আগস্ট বিষয়ক কোনো কথাই তোলা না হয়।
পশ্চিম জার্মানিতে শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া কর্মরত ছিলেন একজন পরমানু বিজ্ঞানী হিসেবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ভারতে নির্বাসনকালেও তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। নয়া দিল্লির অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে চাকরি নেন তিনি এবং ১৯৮২ সাল অবধি সেখানেই কাজ অব্যাহত রাখেন। শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ভারতেই কয়েকটি বোর্ডিং স্কুলে যান। এর মধ্যে ছিল তামিলনাড়ুর পালানি হিলসের কোদাইকানাল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং নৈনিতালের সেইন্ট জোসেফ’স কলেজ। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ব্যাঙ্গালোরে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেন, এবং পরবর্তীতে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের আর্লিংটনে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে।
বিস্ময়কর হলেও সত্য, দিল্লি বাসের সিংহভাগ সময়ই রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন শেখ হাসিনা। তখন ভারতেও চলছিল জরুরি অবস্থা। তাই নিজ দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যতই শোচনীয় হোক না কেন, ভারত সরকারের নির্দেশে ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও শেখ হাসিনা দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশ নিতে পারেননি। তবে আওয়ামী-লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা নিয়মিতই শেখ হাসিনার বাড়িতে যেতেন এবং চেষ্টা করতেন তাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য রাজি করাতে। বিশেষ করে ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতারা বারবার চেষ্টা করতে থাকেন শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য, যেন তিনি তাদেরকে নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কারণে শেখ মুজিবের পরিবারের অবশিষ্ট কারোই বাংলাদেশে প্রবেশ সম্ভব ছিল না। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির পর জিয়াউর রহমান তাকে দেশে ফিরতে দেয়নি, এ কথা তিনি বহুবার বলেছেন। তারপরও ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর ডক্টর ওয়াজেদ অবশ্য চাইছিলেন না যে, তাঁর স্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা ফিরে যান। তিনি মনে করতেন শেখ হাসিনার সরাসরি রাজনীতিতে আসা উচিত নয়।
শেষমেশ ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা মেয়েকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ আর কোরবান আলীর সঙ্গে ঢাকা রওয়ানা হন। ঢাকা বিমানবন্দরে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ তাঁকে স্বাগত জানাতে সেদিন হাজির হয়েছিলেন। সেদিন শুধু ঢাকার তেজগাও বিমানবন্দর নয়, ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মতই তাঁর কন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে সমগ্র ঢাকা নগরী জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিলো। বিমানবন্দর থেকে একটি ট্রাকে করে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে জনস্লোতের ঢেউ পেরিয়ে তিনি মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ের জনসমুদ্রের মঞ্চে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদলেন, সেই সাথে লাখো মানুষ হু হু করে কেঁদে উঠলো। ঠিক যেন বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলরাশি সৈকতে মাথা ঠুকে আছড়ে পড়ছে। সেদিন আকাশ-বাতাস ভেঙে ১৫ আগস্টের জমানো কান্নায় কেঁদে উঠেছিল প্রকৃতিও। অঝোর ধারায় নেমেছিলো বৃষ্টি। শেখ হাসিনা বলেন- বাবা, মা, ভাইদের ও নিকট আত্মীয়দের হারিয়ে তিনি নিঃস্ব। তার কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। তার একমাত্র কামনা হচ্ছে দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন। তিনি দেশের জনগণের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করতে চান।
শেখ হাসিনা দলকে সংগঠিত করার পাশাপাশি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন ও সংগ্রাম চালিয়ে যান। তিনি বিরোধী দলে থেকেই দেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেরিয়ে মানুষের দুঃখ-কষ্টে তাদের পাশে দাঁড়ান, অভাব-অভিযোগ শোনেন। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে কোন এলাকায় কী কী প্রয়োজন সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এবং শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে উন্মোক্ত করেন সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত।
১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ক্ষান্ত হয়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার ক্লান্তিহীন লড়াইকে থামিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে বহুবার। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট , বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের সড়ক বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে চলছিলো দলীয় সমাবেশ। খোলা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া শেষ করলেন সেই সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। সমাবেশস্থলে ট্রাকের চারপাশে তখনো কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থকের ভিড়। ট্রাকের শেষ মাথায় মই লাগানো। নামার জন্য সেদিকে এগিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা। তারপর যা ঘটল, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে নৃশংস ও নিকৃষ্টতম অধ্যায়। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড। একটি নয়, একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকল গ্রেনেড। এতটা দ্রুত একটির পর একটি বিস্ফোরণ সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্রেও কদাচ দেখা যায়। বিস্ফোরণের শব্দ যখন থামল, তখন বোঝা গেল, এ কেবল নিছক শব্দ নয়, এ ছিল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। দেখা গেল গ্রেনেডের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়া মানুষের দেহ এবং তার ওপর দিয়ে জ্ঞানশ‚ন্য মানুষের দিশেহারাভাবে ছুটে চলা। ঘাতকেরা যাঁকে হত্যার জন্য নারকীয় এই আয়োজন করেছিল, সেই শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে যান অলৌকিকভাবে।
এছাড়াও ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে, একই বছরের ১৫ আগস্ট ও ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ফ্রিডম পার্টির কর্মীরা তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডির গ্রিন রোডের পরিবার-পরিকল্পনা ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনকালে গুলিবর্ষণ, ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাবনার ঈশ্বরদীতে ট্রেনে গুলিবর্ষণ, ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কোয়ারে আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা হামলা, ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় গুলিবর্ষণ, ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জনসভার কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা, ২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতু এলাকায় শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখা, ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে গাড়িতে হামলার মাধ্যমে দুর্বৃত্তরা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রায় ২০ বার হত্যার চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রতিবারই তিনি অবিশ্বাস্যভাবে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন এবং দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে এই বাংলার মানুষের কল্যাণে নিজেকে সমর্পণ করেছেন।
প্রাচীন গ্রিক পুরাণে আছে― ফিনিক্স হলো এক পবিত্র আগুন পাখি। এই আগুন পাখির জীবনচক্র আবর্তিত হয় হাজার বছর ধরে। কথিত আছে একবার বিপদসংকুল এই পাখিটি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দগ্ধীভূত এই পাখি তার ছাইভস্ম থেকেই জন্ম নেয় আবার। লাভ করে নতুন জীবন। শুরু হয় তার অবিনাশী যাত্রা। শেখ হাসিনা যেন বাংলার ফিনিক্স পাখি।
লেখক: উপ-পরিচালক, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।