যমুনা বাংলা ওয়েব ডেস্কঃ সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতায় থাকা কালীন সময় ছিলেন দেশটির একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন। সেসময় নিজের ইচ্ছামত নিজের জন্য শতাধিক প্রাসাদ ও সুদৃশ্য ইমারত তৈরি করেছিলেন তিনি। এই সকল প্রাসাদের দেয়ালে দেয়ালে খোদাই ছিলো তার নাম।
আলিশান এই শতাধিক প্রাসাদের বেশিরভাগই রাজধানী বাগদাদ ও রাজধানী থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে সাদ্দাম হোসেনের নিজ জন্মস্থান তিকরিত শহরে অবস্থিত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে বেশিরভাগ প্রাসাদ এখন ধ্বংসস্তুপ কিংবা সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। অপরদিকে কালের করাল গ্রাস থেকে যে সকল প্রাসাদ বেঁচে গিয়েছে, সেগুলোও পড়ে রয়েছে উপেক্ষা ও অবহেলায়।
বসরা, বাবেল এবং আরো কিছু শহরেও এমন কিছু প্রাসাদ আছে যেখানে জীবনে মাত্র একবার কিংবা সাকুল্যে দুইবার গিয়েছিলেন সাদ্দাম হোসেন। এরপরও তিনি এসব প্রাসাদে পূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা রেখেছিলেন। তিনি ছাড়া এগুলো অন্য কারো পরিদর্শনেরও অনুমতি ছিলো না বলে জানা যায়। এমনকি যারা তা নির্মাণ করেছেন তাদেরও না।
প্রাসাদের দেয়ালে সাদ্দাম হোসেনের নাম
গত শতকের আশির দশকের শেষ থেকে প্রাসাদগুলোর নির্মাণ শুরু হয় এবং ৯০ দশকের মাঝামাঝিতে এগুলোর নির্মাণ শেষ হয়। এই সময়কালেই ইরাকের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পূর্ণ মাত্রায় চালু ছিলো।
প্রাসাদের দেয়ালে নিজের নাম খোদাইয়ের সাথে সাথে ‘ইরান’ ও অন্যান্য ‘শত্রুদের’ সাথে সংগঠিত যুদ্ধের নামও খোদাই করেন সাদ্দাম হোসেন। কিন্তু ২০০৩ সালে মার্কিন হামলায় সাদ্দাম হোসেনের ক্ষমতার অবসানে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বেশিরভাগ প্রাসাদই পরিণত হয় ইরাকে আগ্রাসনে অংশ নেয়া বিদেশী সৈন্যদের ঘাঁটিতে। তবে তার আগেই লুটপাট হয় প্রাসাদের মূল্যবান সামগ্রী।
ধ্বংস হওয়া প্রাসাদ
কিছু প্রাসাদ এখনো নামেমাত্র ব্যবহার করা গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধের সময় অনেকগুলো প্রাসাদই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
ইরাকের প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষের প্রধান লাইছ মাজিদ হোসেন বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান, অন্তত বাগদাদে যে প্রাসাদগুলো আছে সেগুলোকে রাজ বংশীয় ও ইসলামিক আর্ট জাদুঘর বানানো সম্ভব।
তিনি বলেন, কিন্তু কয়েকটি বড় প্রাসাদ এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে যেগুলোর স্বাভাবিক মেরামতেই বড় অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন। হয়ত এ কারণেই সরকার সেগুলোকে অবহেলা করে ফেলে রেখেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সরকারি কর্মকর্তা দাবি করেন, ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি প্রাসাদগুলোর সংস্কার এবং এগুলোকে পর্যটন ও সংস্কৃতি কেন্দ্রে পরিণতার করার পথে বড় বাধা।’
আল-ফাও প্রাসাদ
রাজধানী বাগদাদের প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ কমপ্লেস্কের বেশ কয়েকটি ভবন এখনো সরকারি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এর মধ্যে আল-ফাও প্রাসাদে বর্তমানে বেসরকারি ‘আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব ইরাক’ চালু হয়েছে। এই প্রাসাদটিই ইরাকের প্রথম সরকারি প্রাসাদ, যেটি বেসরকারি কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। নান্দনিক এই প্রাসাদ ঘিরে রয়েছে আরো কিছু ছোট ছোট সুরম্য ভবন। বিচিত্র প্রকারের পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে এই ভবনগুলো।
তাছাড়া আল-ফাও মহলে সৌন্দর্যের কোনো কমতি রাখা হয়নি। এমনকি তাতে কৃত্রিম হ্রদও তৈরি করা হয়েছে। বাগদাদ বিমানবন্দরের অদূরে এটিকে নির্মাণ করা হয়েছিল, যাতে ভিআইপি অতিথিদের এখানে অভ্যর্থনা জানানো যায়। ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের পর প্রাসাদটিকে মার্কিন সামরিক বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে পরিণত করা হয়।
বসরার ৩টি প্রাসাদ
ইরাকের সর্ব দক্ষিণে শাতিল আরব নদীর তীরে বড় বড় তিনটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন সাদ্দাম হোসেন। বর্তমানে এই প্রাসাদগুলোর দুইটি ইরান সমর্থিত ইরাকি শিয়া সশস্ত্র সংগঠন হাশদ আল-শা’বির সদর দফতর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তৃতীয় প্রাসাদটিকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে।বসরার ঐতিহ্য বিষয়ক পরিদর্শক কাহতান আল-ওবায়েদ গর্বের সাথে বলেন, ‘আমরা স্বৈরতন্ত্রের প্রতীককে সাংস্কৃতিক প্রতীকে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছি।’বসরার এই প্রাসাদটিই একমাত্র উদাহরণ, যেটিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রাসাদ দেয়ালে খচিত যুদ্ধের নাম
বাগদাদের দক্ষিণের প্রাচীন নগরী বাবেলের পাহাড়ের ৯০ মিটার উঁচুতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন সাদ্দাম হোসেন। স্থানীয় কর্তপক্ষ বর্তমানে এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছে। প্রাসাদের দেয়ালে সাদ্দাম হোসেনের নামের পাশাপাশি বখত নসরসহ প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতার একাধিক কীর্তিমান শাসকের নাম খোদাই করা রয়েছে। এছাড়াও ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরানের সাথে ইরাক যেসব যুদ্ধে লড়েছে ওইসব যুদ্ধের নামও খচিত আছে প্রাসাদের দেয়ালে।
পরিত্যাক্ত হল ও জরাজীর্ণ ঝাড়বাতি
বিরান প্রাসাদের আলিশান হলগুলোতে এখনো ঝুলছে রঙবেরঙের ঝাড়বাতি। মানুষ এখন এই প্রাসাদগুলোতে বেড়াতে আসে এবং নিজেদের ছবি তোলে।
বাবেল রিসোর্টের ডাইরেক্টর আবদুস সাত্তার নাজি বলেন, ‘যখন আমরা ২০০৭ সালে এখানে আসি, তখন এখানের অব্স্থা ছিল খুবই করুণ। পরে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে এটিকে বাবেল ও আশপাশের বাসিন্দাদের জন্য বিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত করা হয়।’
তিকরিতের ধ্বংসাবশেষ
বাগদাদের উত্তরে দজলা তীরের সুন্দর এক শহর তিকরিত। এখানের প্রেসিডেন্ট কমপ্লেক্সে ৩০টিরও বেশি প্রাসাদ রয়েছে। তবে এগুলোর বেশিরভাগই উগ্রবাদী গোষ্ঠী আইএসের সাথে যুদ্ধে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। এরমধ্যে ছোট্ট একটি ইমারত, যেটিতে দজলা প্রতিবিম্বিত হয়। এটিকে বর্তমানে সমাধিসৌধে রূপান্তর করা হয়েছে।
২০১৪ সালের জুনে এই প্রাসাদেই আইএস অন্তত এক হাজার সাত শ’ ইরাকি সৈন্যকে হত্যা করে, যাদের কাছাকাছি সামরিক ঘাঁটি থেকেই অপহরণ করে আনা হয়। হত্যার পর তাদের এই প্রাসাদেই সমাহিত করা হয়।
সূত্র : আলআরাবিয়া