হীরেন পণ্ডিত
নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটের ১২ সিনেটরের পাঠানো চিঠি প্রত্যাহার করতে পাল্টা চিঠি দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের তিন আইনজীবী। সম্প্রতি ইমেইল ও ডাকযোগে সিনেটর রিচার্ড ডারবিন বরাবর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং পৃথক। নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কোনো বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ বা বিচারিক কার্যক্রমে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এছাড়া চলমান বিচারিক কার্যক্রম সম্পর্কে বিবৃতি বা চিঠি প্রদান ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য শ্রম আইনের অধীনে মামলা দায়ের করেছে। সেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। কাজেই ১২ জন সিনেটরের পাঠানো চিঠির মর্মার্থ অনুযায়ী তারা দুর্বল শ্রমিকদের বিপক্ষে এবং সবল মালিকদের পক্ষ নিয়েছেন। যা আইএলও কনভেনশনের লঙ্ঘন। আইনজীবীদের পাঠানো চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, একটি দেশের অভ্যন্তরীণ চলমান বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে এই ধরনের তাগিদপত্র দেওয়া শিষ্টাচার বহির্ভূত এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনাকাক্সিক্ষত হস্তক্ষেপের শামিল, অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং নিন্দনীয়। কাজেই প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিটি অবিলম্বে প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করা হলো
ড. ইউনূসকে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর কিছু বিধান লঙ্ঘনের জন্য বিচার করা হয়েছিল যেমন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ৬৭ জন কর্মচারীকে স্থায়ী করতে ব্যর্থতা, কর্মচারীদের অংশগ্রহণ এবং কল্যাণ তহবিল গঠনে ব্যর্থতা এবং কোম্পানির লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশ অবদান রাখতে ব্যর্থতার জন্য। এই তহবিলে। ড. ইউনূস তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর কোনোটিই খণ্ডন করতে ব্যর্থ হন।
ড. ইউনূসের আইনজীবীরা আদালতকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ গ্রামীণ টেলিকমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় কারণ তাদের নিজস্ব চাকরির নিয়ম রয়েছে। যাইহোক, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ৩ বলে যে একটি সংস্থার কর্মসংস্থানের নিয়মগুলি অবশ্যই আরও ভাল শ্রম অধিকার প্রদান করবে। যাইহোক, ড. ইউনূসের আইনজীবীরা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন যে গ্রামীণ টেলিকমের চাকরির বিধান বাংলাদেশ শ্রম আদালত ২০০৬ এর চেয়ে ভাল।
বাংলাদেশের খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার আশস্ত করেছেন যে ড. ইউনূস তার মামলা চালাবার জন্য এবং তার অনুকূলে মামলার রায় আনয়নের জন্য বিশ্বের যেকোনও প্রান্ত থেকে আইনজীবী নিযুক্ত করতে পারেন। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের শুভাকাঙ্ক্ষীরা যদি দেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে প্রাপ্ত তার সাম্প্রতিক ছয় মাসের কারাদণ্ডে কোনও আইনি অপূর্ণতা বের করে থাকেন, তবে তাদের এই সত্যটি জানা জরুরি যে বাংলাদেশে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। বাংলাদেশের একজন নোবেল বিজয়ীসহ এটিই সাজাপ্রাপ্তির একমাত্র উদাহরণ নয়।
ড. ইউনূসের মতো একজন বিতর্কিত আচরণের মানুষের পক্ষে দেশের ও বিদেশের তথাকথিত বিজ্ঞ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ যখন ওকালতি করেন, তখন অবাক না হয়ে পারা যায়না। কোনো মানুষ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ও খ্যাতিমান হয়ে উঠলে কি নিজ দেশের আইন আদালতের ঊর্ধ্বে উঠে যান? নিজের আখের গোছানোর জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সুনাম কাজে লাগিয়ে অন্য মানুষদের ঠকিয়ে, বঞ্চিত করে আইনের আওতামুক্ত থাকার লাইসেন্স পেয়ে যান?
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েকজন নোবেল বিজয়ীকে কৃত অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। অনেক রাজনীতিবিদকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয় যেমন হেনরি কিসিঞ্জার যিনি পূর্ব এশিয়াকে ধ্বংস করেছিলেন, বারাক ওবামা যিনি লিবিয়াকে ধ্বংস করেছিলেন এবং আবি আহমেদ যিনি পরে গৃহযুদ্ধ করেছিলেন। তারা সবাই মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটিকে তাদের ঋণ পরিশোধ করেছেন। সুতরাং অনেক সময় গোল্ড মেডেল বা নোবেল পুরষ্কার গ্যারান্টি দেয় না যে একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত অপরাধী হতে পারে না। বরং এটি প্রমাণ করতে পারে যে পুরস্কারগুলো ভুল ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছিল এবং এর ফলে পুরস্কারগুলিকে অসম্মান করা হয়েছিল।
অকাট্য প্রমাণ ছাড়া ড. ইউনূসের মত এত বড়মাপের একজন নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী মানুষের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণের মতো সাহস কোনও থানা-পুলিশ কিংবা আদালত করবে না এটা সহজেই অনুমান করা যায়। গ্রামীণ টেলিকমের দীর্ঘ বঞ্চিত সংক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে প্রচলিত শ্রম আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তাছাড়া সম্প্রতি ১২ জন মার্কিন সিনেটরদের দেয়া চিঠিতে সরকার কর্তৃক ইউনূসের প্রতি লাগাতার হয়রানির যে অভিযোগ আনা হয়েছে তাও প্রশ্নবিদ্ধ।
সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে বিজ্ঞ সিনেটররা কী ড. ইউনূসকে এই মর্মে চারিত্রিক সনদ দিয়েছেন যে, তার মতো একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আপরাধ করা তো দূরের চিন্তাও হয়তো করতে পারেন না। বরং বিগত দেড় দশক ধরে ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে ক্ষমতার মসনদে বসার একটি মোহ ও সুপ্ত বাসনা নিয়ে বসে আছেন বলেই দেশে ও বিদেশে কমবেশি অবগত আছেন সবাই ।
ড. ইউনূস বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী। তিনি বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বন্ধু ও প্রিয়পাত্র এটাও সত্য। এমন বিশ্বজুড়ে খ্যাতির অধিকারী আর কোনো মানুষের নাম কি আমরা জানি যিনি লাভজনক ব্যবসায় জড়িয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের ঠকিয়েছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ২০২৪ সালের ১লা জানুয়ারি ঢাকার একটি শ্রম আদালত ছয় মাসের কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন। এই বিচার প্রক্রিয়া এড়িয়ে গেলে সেটা কি ওই বক্তব্যকেই সঠিক প্রমাণ করতো না যে বাংলাদেশে আইন সবার জন্য সমান নয়! আইনের চোখে খ্যাতিমান আর অখ্যাত সবাই সমান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১২ জন বিশিষ্ট সিনেটরের লেখা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সাম্প্রতিক চিঠিটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক আলোচনার ঝড় তুলেছে। চিঠির বিষয়বস্তু নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচার প্রক্রিয়ার বিষয়ে উদ্বেগ এবং তার দায়মুক্তি প্রত্যাশা। বিষয়টি একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের পর্যায়ে কিনা ও এর প্রাসঙ্গিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অন্য দেশের আইনি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশের শীর্ষ সিনেটরদের এই ধরনের রাজনৈতিক চিঠি দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে সঙ্গত প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। একটি সার্বভৌম দেশের আইনি প্রক্রিয়ায় এই ধরনের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
সিনেটের মেজরিটি হুইপ ডিক ডারবিন এবং সিনেটর টড ইয়ং, টিম কেইন এবং অন্যদের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বসহ সিনেটররা, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচার কার্যক্রমকে ‘নিরবচ্ছিন্ন হয়রানি’ হিসেবে অভিহিত করে এর সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে তাদের সম্মিলিত আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সিনেটরদের চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এসব উদ্বেগ দূর করার এবং তাদের ভাষায়, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহার বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিদগ্ধ মার্কিন সিনেটররা বেশ জোরেশোরেই অধ্যাপক ইউনূসের পক্ষ নিয়েছেন। এর আগে প্রভাব খাটিয়েছেন কিংবা বিশ্বনেতাদের দিয়ে খোলা চিঠি লিখিয়েছেন। ৪০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি তারপর আরো ১৬০ বিশিষ্ট জনের বিবৃতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ৪০ বিশ্ব নেতা যৌথভাবে ওয়াশিংটন পোস্টে একটি পূর্ণ-পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন হিসাবে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেছিলেন যার মূল্য ছিলো ৭৩,০৩৩ মার্কিন ডলার।
ড. ইউনূস তার বিরুদ্ধে আনীত মামলা ও অভিযোগের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে যা বলে আসছেন, সিনেটরদের চিঠি যেন তারই প্রতিধ্বনি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যদি ভবিষ্যতে কখনো জানা যায় যে চিঠিটি ইউনূস নিজেই লিখেছেন এবং স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সিনেটরবৃন্দ নির্ধারিত স্থানে সই প্রদান করেছেন। নিশ্চয় এবারো প্রভাবশালী কোন লবিস্ট ফার্ম এই স্বাক্ষরগুলো সংগ্রহ করার ব্যাপারে দায়িত্ব নিয়েছিলো।
চিঠি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এত ভিত্তিহীন পক্ষপাতিত্ব এবং উদ্দেশ্যমূলক ওকালতির উপাদানগুলো ভীষণভাবে চোখে পড়ে। চিঠির দাবি ড. ইউনূস শতাধিক অপ্রমাণ্য মামলার মুখোমুখি হয়েছেন এবং কিছু মানবাধিকার সংস্থা তার বিরুদ্ধে আইনি কার্যক্রমে অনিয়ম-এর কথা উল্লেখ করেছে।
সিনেটরদের চিঠির জবাবে, বাংলাদেশ সরকার এবং কয়েকজন বুদ্ধিজীবী এই ধরনের হস্তক্ষেপের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, বিষয়টি সাবজুডিস হিসেবে তার আইনি স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বদানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। এটি সব আইনের একটি মৌল শর্ত যে বিচারাধীন কোনও বিষয়ে বাদী-বিবাদীসহ অন্য সব পক্ষেও কেউই কোনোরূপ মন্তব্য করতে পারবে না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কোনোভাবেই বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে- এমন কাজ করতে পারবে না। মার্কিন সিনেটরদের চিঠি কি এই সর্বজনীন আইনি শর্ত লঙ্ঘন করে না?
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আইনি মামলার প্রেক্ষাপট পুরো পরিস্থিতিকে গুরুতর করে তুলেছে। এই মামলার ভিত্তি তৈরি করেছে শ্রম অধিকার লঙ্ঘন এবং আর্থিক অনিয়মের আমলযোগ্য অভিযোগগুলো। প্রসিকিউটররা দাবি করেন যে অভিযোগগুলো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়, বরং সেগুলো গ্রামীণ টেলিকমে প্রফেসর ইউনূসের কর্মকাণ্ডের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ড. ইউনূস সরকারের রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার বলে যেভাবে তিনি নিজে দাবি করেন, কিংবা এক ডজন মার্কিন সিনেটর যেভাবে বলেছেন তার কোনও বস্তুনিষ্ঠতা মেলে না। আমাদের দুদককে রাজনৈতিক বিরোধীদের বিচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে তাদের দাবি। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও পছন্দের ব্যবসায়িক বন্ধুদের বিদ্যমান সুস্পষ্ট দুর্নীতির ব্যাপারে তারা যেন অন্ধ। ড. ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠন করে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা পূরণ হয়নি। এই ব্যর্থতার জন্য তিনি আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনাকে দায়ী করেন কি-না, তা জানা না গেলেও বর্তমান সরকারের প্রতি তাঁর বিরূপতা গোপন নয়।
ড. ইউনূসের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সেই টানাপড়েন তীব্র হয়, যখন তিনি আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও কার্যক্রমে লবিস্ট হিসেবে কাজ করতে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, কথিত দুর্নীতির আন্তর্জাতিক অপপ্রচারের মাধ্যমে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বাতিলের নেপথ্যেও ছিলেন ড. ইউনূস।
ড. ইউনূসের মানবিক সেবা কার্যক্রমের কোনো নমুনা কি ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে-পরে সংখ্যালঘুদের ওপর ঘৃণ্য নিপীড়নের সময় দেখা যায়নি। দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ব্যাপারে কখনো কথা বলেছেন, সাম্প্রদায়িক শক্তির অপতৎপরতা কিংবা জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিপদ নিয়েও মুখে কোনো কথা পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ উল্লেখ করেন, ড. ইউনূসের মামলার কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি এবং পড়বেও না। দেশবিরোধী প্রচারণায় ড. ইউনূস বহু লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছেন, কিন্তু সেগুলো কিছুই করতে পারেনি। এত কিছুর পরও অনেক বিনিয়োগ এসেছে দেশে। সরকার ইউনূসের মামলার কোনো পক্ষ না।’
আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে জাতীয় মর্যাদা অর্জন করেছি তা আমাদের বিসর্জন দেওয়া উচিত নয়। এই বিষয়গুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের মনে রাখা উচিত যে বাংলাদেশ সাশ্রয়ী মূল্যে তৈরি পোশাক পণ্য সরবরাহ করছে। এত কম দাম তারা দুনিয়ায় কোথাও পাবেনা। তাই তারা আমাদের সাথে ব্যবসা করছে, কারণ তারা পরোপকারী এবং দাতব্য কাজ করছে না বরং তাদের কোম্পানিগুলি প্রচুর লাভ করতে পারে বলে।
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে বাংলাদেশে এসে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহম্মদ ইউনূসের বিচারকার্যক্রম পর্যবেক্ষণের অনুরোধ জানিয়েছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান। তিনি এও উল্লেখ করেছিলেন শ্রম আদালতে এলেই বুঝতে পারবেন ড. ইউনূস শ্রমিকদের সঙ্গে কি করেছেন। না দেখে সমালোচনা করাটা আমাদের সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি কথা দিচ্ছি আপনি (হিলারি ক্লিনটন) এলেই সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো। আপনি যে কাগজপত্র চাইবেন সব দেবো। শ্রম আদালত এবং হাইকোর্টের রায়ের কপি দেখাবো আপনাকে।
সব কিছু দেখে পর্যবেক্ষণ করে আপনি আলোচনা-সমালোচনা করুন। না বুঝলে আপনি দুজন এক্সপার্ট নিয়ে আসুন। তারপর আপনার সিদ্ধান্ত দেন। দুদকের আইনজীবী আরও বলেন, কোনো কিছু না জেনে শুধুমাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে পর্যবেক্ষণ দেওয়া আমি মনে করি আপনার মতো একজন বিশ্বনেত্রীকে মানায় না। এর আগে মঙ্গলবার এক টুইট বার্তায় ড. ইউনূসের পাশে দাঁড়াতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান হিলারি ক্লিনটন। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো ১৬০ জনের বেশি বিশ্বনেতার বিবৃতিটি সংযুক্ত করেন।
৩১ আগস্ট ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারিক কাজ শুরু হওয়ার কারণে ১০০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০ জনেরও বেশি বিশ্ব নেতা একটি নতুন চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। জনশ্রæতি আছে যে ৪০ জনের পরে ও পরে ১৬০ জনের বিৃবতি সংগ্রহ করতে লবিস্ট ফার্মগুলোকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার প্রদান করতে হয়েছে।
দেশের বিবেকবান নাগরিক হিসেবে আমরা বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়ার ওপর এ ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। খোলা চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু আইনি ও নৈতিক প্রশ্ন সামনে চলে আসে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪(৪) অনুযায়ী বিচারকরা তাদের বিচারিক কাজে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত কারও বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার নেই। উল্লিখিত চিঠির বক্তব্য বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) স্বীকৃত শ্রমিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে হেয় করার শামিল বলে আমরা মনে করি।
সংবিধান অনুযায়ী সব নাগরিকই আইনের দৃষ্টিতে সমান, লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধানে সবারই আইনি সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ড. ইউনূসের বিচারকাজও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ও স্বাধীনভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে ‘বিচারিক হেনস্তা’র অভিযোগ অমূলক ও অনভিপ্রেত। পাশাপাশি ড. ইউনূস বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সবসময়ই দেশ-বিদেশে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সব কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক