দলে গণতন্ত্রের চর্চা না করে রাষ্ট্রে কীভাবে গণতন্ত্র আনবে বিএনপি?

দিনকাল বাংলাদেশ

কঙ্কা কণিষ্কা

২০০৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়াকে দলের আজীবন চেয়ারপারসন ঘোষণা করে বিএনপি। খালেদা জিয়াও এই ঘোষণা সানন্দে মেনে নেন। অথচ বিএনপির গঠনতন্ত্রে ছিল, কোন ব্যক্তি উন্মাদ, দেউলিয়া বা দণ্ডপ্রাপ্ত হলে দলের নেতৃত্বে আসতে পারবেন না। কিন্তু ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের আগে হঠাৎ কোনো সম্মেলন ছাড়াই এই ধারাটি বাতিল করে দেয়। গঠনতন্ত্রে আরও বলা ছিল, সম্মেলন ছাড়া দলের সংবিধানের কোন বাতিল করা যাবে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের তৃণমূল পর্যায়ের একজন নেতা জানান, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী খালেদা জিয়ার দলীয় প্রধান থাকা নিয়ে যেন কোন প্রশ্ন না ওঠে, সেজন্যেই এরকম সিদ্ধান্ত।

 

এর আগেও খালেদা জিয়ার আজীবন দলীয় পদে থাকার ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, বিষয়টি জানতে চাইলে ওই তৃণমূল নেতা জানান,  কর্মীদের উপর বিশ্বাস না থাকায় এরকম সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া  বিএনপিতে নতুন নয়। একই রকম ভাবে দলের দ্বিতীয় সারির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, দলে প্রথম থেকেই গণতন্ত্র চর্চা ছিল না। এখন আরেক ধাপ এগিয়ে দলে এখন একনায়কতন্ত্র শুরু হয়েছে। বিএনপি পরিচালনার ভার এখন কেন্দ্রে যাদের উপর দেয়া হয়েছে তারাও কিছু জানেন না। সব ধরণের নির্দেশ আসছে লন্ডন থেকে।

 

বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা এবং এক তৃণমূল নেতার এরকম অভিযোগের সত্যতা মেলে, বিএনপির অসন্তুষ্ট কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে। তারা জানান, কার্যত দল এবং দলের বাইরে কোথাও গণতন্ত্রের চর্চা নেই। বিএনপিসহ তার অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোতেও নেই গণতন্ত্রের চর্চা। নিয়মিত সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব তৈরি না করে ভারপ্রাপ্ত নেতাদের দিয়ে কোন রকমে চলছে দলীয় কার্যক্রম । সম্মেলন জট তৈরি করে রাজনীতির নামে দলীয় নেতাকর্মীদের এক ধরনের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করছে জিয়া পরিবার। যে কারণে বিএনপি বিমুখ হচ্ছে তৃণমূল, মানছে না হাইকমান্ডের নির্দেশ।

 

নেতা কর্মীরা আরও জানান, গঠনতন্ত্রে প্রতি তিন বছর পর পর সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় আট বছর যাবৎ বিএনপির সম্মেলন হচ্ছে না। সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ । এর আগে বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। অর্থাৎ তিন বছরের কমিটিকে ৮-৯ পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যায় বিএনপি। একই ভাবে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কাঠামোগুলো ভেঙ্গে ফেলেছে স্বেচ্ছাচারীরা। তাদের বর্ননা অনুযায়ী আমরা অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অবস্থা দেখে নিতে পারি।

 

ছাত্রদল

২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে সভাপতি ও সাইফ মাহমুদ জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। সরকার পতনের আন্দোলনে সহিংসতা করতে ব্যর্থ হওয়ায় লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশে ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট শ্রাবণকে বহিষ্কার করা হয় । এখন কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হয়েছেন রাশেদ ইকবাল খান। আগে থেকে কোন বার্তা না দিয়ে লন্ডনের একটি ফোনকলে একজন নেতাকে হুট করেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়টি মানেনি ছাত্রদলের একটি বড় অংশ। যে কারণে তাদের সাংগঠনিক কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদল দেখা যায় না। অছাত্রদের দিয়ে চলছে সংগঠন।

 

মহিলাদল

২০১০ সালে নূর-ই-আরা সাফা সভাপতি এবং শিরিন সুলতানা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। প্রায় ছয় বছর পর আবার ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসকে সভাপতি ও সুলতানা আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। দুই বছর মেয়াদের কমিটির নিয়ম থাকলেও ৭-৮ বছরেও গণতান্ত্রিক ধারায় সম্মেলন করার কোন চেষ্টাই করেনি মহিলা দল।

 

জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)

জাসাস নামে সংগঠন থাকলেও গত ১৫ বছরে তাদের কোন কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ড. মামুন আহমেদ ও হেলাল খান নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর হেলাল আহবায়ক ও জাকির হোসেন রোকনকে সদস্য সচিব করে ২০২১ সালের ৬ নভেম্বর ৭১ সদস্যের আহবায়ক কমিটি ঘোষণা হয়।  তবে জাসাসের নতুন কমিটি গঠনের পর ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। হেলাল খান বছরের ১১ মাস আমেরিকা থাকেন। সদস্য সচিব জাকির হোসেন রোকন, তার অতীত জীবনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কোন কাজ ছিল না কখনো।

 

শ্রমিক দল

২০১৪ সালের ১৯ ও ২০ এপ্রিল জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের জাতীয় কাউন্সিল হয়। আনোয়ার হোসাইন ও নূরুল ইসলাম খান নাসিম নেতৃত্বাধীন শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি বর্তমানে ১০ বছর যাবত চললেও নতুন সম্মেলনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

 

মুক্তিযোদ্ধা দল

মুক্তিযোদ্ধা দলের সর্বশেষ কাউন্সিল হয় ২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর। ১১ বছর পার হলেও তাদেরও নতুন সম্মেলনের কোনো খোঁজ নেই।

 

দলের সবখানে এরকম অগণতান্ত্রিক চেহারা দেখতে চান না বেশিরভাগ নেতা। যে কারণে তারা খালেদা জিয়াকে বিএনপির আজীবন চেয়ারপারসন ঘোষণার অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তও মেনে নেননি। কারণ খালেদা জিয়া এখন বিএনপির স্থায়ী নেতা। আর কখনও তাকে কর্মীদের সমর্থন নিতে হবে না। কখনও কাউন্সিল করে তাকে বাদও দেয়া যাবে না। একই ভাবে ২০০২ সালে তারেক রহমানের মত একেবারেই নবীশ কোন লোককে যখন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তখনও আপত্তি উঠেছিল। তারা তখন বলেছিলেন, এটা শুধু স্বজনপ্রীতি হলো না পাশাপাশি অগণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার এক ঘৃণিত উদাহরণ তৈরি হলো।

 

এতসব উদাহরণের উপর ভিত্তি করে রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলেন, যে দল নিজেদের পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নিয়ম মানে না, তারা কিভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতন্ত্র কায়েম করবে? যে দলে গণতন্ত্র নেই, সে দল গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে যতই চিৎকার করুক, জনগণ তাদের পক্ষে সায় দেবে না। দলের ভিতর এই অগণতান্ত্রিক একচ্ছত্র ক্ষমতা চরম দুর্নীতির জন্ম দেয়।

 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *