ড. বিমান চন্দ্র বড়ুয়া
গণতান্ত্রিক চর্চায় নির্বাচন অন্যতম অনুষঙ্গ। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা গণতন্ত্রে প্রতিফলিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুবর রহমান সংবিধানে ‘গণতন্ত্র’ বলতে বুঝিয়েছেন ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে’।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলো অন্যতম ভূমিকা পালন করে। বলা চলে, রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় ভূমিকা গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ধারণে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়ে এদেশে গণতন্ত্র প্রবর্তন করে বাংলাদেশের নাম দিয়েছেন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সামরিক অবৈধ হস্তক্ষেপে বাংলাদেশর গণতন্ত্র ব্যাহত হয়েছে। ৯০-এর সামরিক শাসনের অবসানের পর থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সাংবিধানিক নিয়মে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় ৭ই জানুয়ারি ২০২৪ রবিবার বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সিইসি’র তথ্য অনুসারে ৪১.৮% শতাংশ ভোট পড়েছে।
অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতা উপেক্ষা করে ৪১.৮% শতাংশ মানুষ যে ভোট দিয়েছে, গণতান্ত্রিক চর্চার পথ সুমজ্জ্বল ও সমুন্নত রাখতে সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে ভারত, চীন এবং রাশিয়াসহ পৃথিবীর বহুদেশ শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
নারী, সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীদেরও ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ যা অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনকে সমৃদ্ধ করে রাজনৈতিক বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য এনে দিয়েছে। এই নির্বাচনের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো বিপুল সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর অংশগ্রহণ।
বিভিন্ন আসনে ৪৩৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিভিন্ন প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ীও হোন। এই ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয় প্রমাণ করে ভোট নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে এবং গণতন্ত্রের জয় হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে বিগত ১৫ বছরে এদেশে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষাখাত, প্রযুক্তিখাত, নারী শিক্ষা, স্বাক্ষরতার হার, গড়ায়ু বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নসহ সর্বক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্ব প্রতিফলিত হয়েছে।
এজন্য বিশ্বদরবারে শেখ হাসিনা প্রশংসিত হয়েছেন এবং বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে, তরুণ এবং যুবকদের কাছে তিনি আইকন হয়ে উঠেছেন। শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রেখে, গণতান্ত্রিক চর্চা সমুন্নত রাখতে তরুণ এবং যুবকরা স্মার্ট ও উন্নত বাংলাদেশের পথচলার ভোট বিপ্লবে শামিল হয়ে শেখ হাসিনাকে জোরালো সমর্থন দিয়ে পুনরায় সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি জনবান্ধব রাজনৈতিক সংগঠন। একটি বিষয় স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়, তা হলো শেখ হাসিনার প্রতি এদেশের জনসাধারণের আস্থা।
তার প্রতি আস্থা রাখার কারণ তিনি এদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। সর্বস্তরের শান্তিপ্রিয় জনগণ প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে ভোট প্রদান করে গণতন্ত্রকে সমুন্নত করেছে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শাসনব্যবস্থার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে।
একটানা চতুর্থবার ও মোট পঞ্চম বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ হাসিনা। একটানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হবার গৌরব নেই ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ব্রিটেনের লৌহমানবী খ্যাত মার্গারেট থাচারেরও। একদিনে দেড়শ সেতু উদ্বোধন করে যেমন বিশ্বরেকর্ড করেছেন তেমনি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ শেখ হাসিনাকেও ভোট দিয়ে রেকর্ড বইয়ে স্থান করিয়ে দিয়েছে।
শেখ হাসিনার সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো নাশকতা ও অগ্নিসন্ত্রাসকে দমন করা। দুর্নীতি রোধ করা। জঙ্গিবাদ দমন করা। বিনিয়োগ বৃদ্ধি, গার্মেন্টস শিল্পের অস্থিরতা সমাধান করা, দলের অভ্যন্তরে হাইব্রিড ও অযোগ্যদের সিন্ডিকেট দমন করা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইতোমধ্যে সর্বসাধারণের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটিও নতুন গঠিত শেখ হাসিনা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
দেশে-বিদেশে শেখ হাসিনার শত্রু। সব সময় দেখা যায়, একটি চক্র সিন্ডিকেট করে শেখ হাসিনা সরকারকে কীভাবে বিশ্বদরবারে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়, সেই চক্রান্ত করতে থাকে। সুতরাং নতুন সরকারকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি সুনজরে এনে সকল সিন্ডিকেটের কালো থাবা থেকে মুক্ত করতে হবে।
এছাড়া শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা, চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়ন, সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। আশাকরি, শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে সবধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
মেট্রোরেল, টানেল, পদ্মাসেতু, পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল নির্মাণ, উন্নত রাস্তাঘাট, এসব এখন শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয় বরং শেখ হাসিনা সরকারের বিগত ১৫ বছরের অভূতপূর্ব উন্নয়ন বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণ ও সার্বিক অগ্রগতিতে অসামান্য সংযোজন ও দৃশ্যমান বাস্তবতা।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর জনবিচ্ছিন্ন আন্দোলনের নামে নাশকতা, সহিংসতা ও নৃশংসতা এদেশের মানুষ ও বিশ্ববাসী দেখেছে। চলন্ত ট্রেনের ভিতর আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা কোনো সভ্য রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড হতে পারে না। এদেশের মানুষ এসব অগ্নিসন্ত্রাসীদেরকে ভয় পায়। ভোটের মাধ্যমে তারা এর সমুচিত জবাবও দিয়েছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকারের কাছে এদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে স্মার্ট ও উন্নত বাংলাদেশ। দেশি- বিদেশি সকল প্রকার ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতাকে মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে স্মার্ট ও উন্নত বাংলাদেশে পরিণত করতে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।
ড. বিমান চন্দ্র বড়ুয়া
অধ্যাপক, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, পরিচালক, সেন্টার ফর বুদ্ধিস্ট হেরিটেজ এন্ড কালচার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।