যমুনা ওয়েব ডেস্কঃ দেশকে মায়ের আসনে, বসিয়ে তার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার কারনেই পাকিস্তানের মাটিতে দাঁড়িয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে, স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন যিনি, তিনি আর কেউ নন, আমাদের অতি আদরের, পরম কাছের, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান (Bir Shrestho Matiur Rahaman)। কতটা ভালোবাসা আর আবেগ বুকের মধ্যে জমানো থাকলে, একজন মানুষ নিজের নিশ্চিত মৃত্যুর কথা বেমালুম ভুলে, স্বপ্ন দেখতে পারেন এমন এক স্বাধীন বাংলার, যার সবুজ বুকে থাকবে উদীয়মান লাল সূর্য, আর তাকে ঘিরে থাকবে প্রকৃতির নির্মল ছায়া – সেটা সত্যিই কল্পনার অতীত । স্বাধীন বাংলাদেশে গর্বিত বাঙালিরা খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারছে, দিনের জন্মের সাথে পুব আকাশে রবির কিরণ শরীরে নরম পরশ দিয়ে যাচ্ছে, সে তো এইসবই শ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্য । আজ এই মহান বাঙ্গালীর জন্মদিন ।
কর্মজীবনে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান (Bir Shrestho Matiur Rahaman) ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট । মতিউর রহমানের জন্ম ১৯৪১ সালের ২৯ শে অক্টোবর পুরানো ঢাকা শহরের ১০৯ নং আগা সাদেক রোডে । তার পৈত্রিক বাড়ির নাম ছিল “মোবারক লজ” । তার বাবা ছিলেন মৌলভী আব্দুস সামাদ এবং রত্নগর্ভা মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন । ১১ ভাই বোনের মধ্যে মতিউর রহমান ছিলেন ষষ্ঠতম ।
মতিউর রহমান ছাত্র জীবনে ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী । ডিস্টিংশন নাম্বার নিয়ে মেট্রিক পরীক্ষায় সুনামের সাথে পাশ করেন তিনি । এরপর ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন । ১৯৬৩ সালের জুন মাসে সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে যোগ দেন । এরপর করাচীর মৌরিপুরে জেট কনভার্সন কোর্স শেষ করে, পেশোয়ারে গিয়ে জেট পাইলট নিযুক্ত হন । ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন । ১৯৬৮ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন ।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ছুটিতে সপরিবারে ঢাকায় আসেন । এরপর আসে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের সেই কালো রাত । ঘুমন্ত ঢাকার বুকে চলে পাক কসাইদের জঘন্য নরহত্যা । এই ঘটনায় মতিউর রহমান অত্যন্ত মর্মাহত হন । এরপর তিনি দৌলতকান্দিতে জনসভা করেন এবং বিশাল মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজারে যান । পাক সেনাবাহিনী ভৈরব বাজার আক্রমণ করলে তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টের ই. পি. আর.- এর সাথে থেকে সফলভাবে সেটি প্রতিরোধ করেন । ২৩শে এপ্রিল ঢাকায় ফিরে আসেন মতিউর রহমান । এবং ৯ই মে কর্মস্থল পাকিস্তানে ফিরে যান । ফেরার পথে, মনে মনে স্বপ্ন ছিল নরপিশাচদের ঘাঁটি থেকে ছিনিয়ে আনবেন জঙ্গিবিমান । আর মাতৃসম জন্মভূমির গলায় পরিয়ে দেবেন বিজয়মাল্য ।
১৯৭১ সালের ২০শে আগস্ট নিষ্পাপ স্বপ্ন নিয়ে ফ্লাইট সিডিউল অনুযায়ী গাড়ি নিয়ে চলে যান রানওয়েতে । অপেক্ষারত বিমানের সামনে বসেছিল মতিউর রহমানের একজন ছাত্র রশিদ মিনহাজ । মতিউর রহমান বিমান নিয়ে যাওয়ার আগে রশিদ মিনহাজকে অজ্ঞান করে ফেলেন । কিন্তু কপাল মন্দ থাকার কারণে, অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে, কন্ট্রোল রুমকে বিমান ছিনতাইয়ের কথা জানিয়ে দেয় রশিদ । ফলে মতিউর রহমান বিমান নিয়ে পালাবার সাথে সাথে চারটি জঙ্গিবিমান পেছনে ধাওয়া করে । রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য অনেক কম উচ্চতায় বিমান চালাচ্ছিলেন মতিউর রহমান । এক পর্যায়ে রশিদ এর জ্ঞান ফিরে আসে এবং বিমানের ইজেক্ট বোতাম টিপে দেয় । বিমানের উচ্চতা অনেক কম থাকার, কারণে, ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে থাকা থাট্টা এলাকায় বিমানটি ধ্বংস হয়ে যায় । মতিউর রহমানের কোন প্যারাসুট না থাকায় তিনি শহীদ হন।
পরবর্তীকালে পাকিস্তান সরকার রশিদ মিনহাজ কে সম্মানসূচক খেতাব দেয়, আর বাঙালি দেশ প্রেমিক মতিউর রহমানের কপালে ছিল অপমান । পাক হায়েনারা বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে (Bir Shrestho Matiur Rahaman) করাচির মাশরুর বেসের চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে কবর দেয় । আর কবরের ফলকে লিখে দেয় –“ইদার শো রহা হ্যাঁ এক গাদ্দার” ।
বাংলাদেশ আজ স্বাধীন । নিজেকে দেশমাতৃকার জন্য আত্ম বদলি দিয়েও ৩৫ বছর সেই সাহসী মনে আর মুখে হাসি নিয়ে, অপমানের গ্লানিসহ সহে গেছেন সবকিছু । ২০০৬ সালের ২৩ শে জুন মতিউর রহমানের পবিত্র দেহাবশেষ নিয়ে আসা হয় স্বাধীন বাংলার মাটিতে । বাঙালি জাতির গর্ব এই বীর সন্তান কে পূর্ণ মর্যাদায় ২৫ শে জুন ২০০৬ সালে “ শহীদ বুদ্ধিজীবী” কবরস্থানে পুনরায় সমাধিস্থ করা হয় । দামাল ছেলে কে দীর্ঘদিন বাদে ফিরে পেয়ে, পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে নিয়েছে সোনার মাটি । হয়তো সবার অলক্ষ্যে, মায়ের মতো মাটি কেঁদেছিল তার সন্তানকে আবার কোলে ফিরে পেয়ে । এই আত্মত্যাগ, এই সাহস, দেশের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে কি বীরশ্রেষ্ঠ বলা চলে ? মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান তখন পাকিস্তানের ছিলেন । মিলি রহমান ও তার শিশুকে পাকিস্তানিরা এক অন্ধকার কক্ষে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখে । পাশাপাশি চলে পাশবিক অত্যাচার । পরবর্তীকালে তিনি মুক্তি পান এবং বাংলাদেশে ফিরে আসেন ।
মতিউর রহমান ইচ্ছা করলে স্ত্রী আর পরিবারকে নিয়ে আকর্ষণীয় বেতনসহ বাকী জীবন পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়ে দিতে পারতেন । অথচ, তিনি আর দশটা মানুষের মত সহজ রাস্তায় সহজ চিন্তা করেন নি । দেশ প্রেম ছিল তাঁর পরিবারেরও আগে । তাই তো তিনি অবলীলায় সমস্ত পেছন টান পিছনে ফেলে, প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে দেশের জন্য আত্ম ত্যাগ করতে দুই বার ভাবেননি ।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের জন্য যে সাত জনকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেওয়া হয়, তার মধ্যে মতিউর রহমান অন্যতম ।
সুত্রঃ বংদুনিয়া