প্রভাষ আমিন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১১ জানুয়ারি তারিখটি খুবই গুরুত্বপুর্ণ। সাধারণে দিনটি ১/১১ নামেই পরিচিত। ২০০৭ সালের এই দিনে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে পাল্টে দিয়েছিল রাজনীতির গতিপথ। বিরাজনীতিকীকরণের লক্ষ্য নিয়ে এসেছিল অস্বাভাবিক সে সরকার। সেই লক্ষ্যে তারা প্রথমে গ্রেফতার করেছিল আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। যদিও তার ঠিক আগে ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের পর তীব্র সমালোচনার মুখে ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে পরে গ্রেফতার করা হয় খালেদা জিয়াকেও।
১/১১ সরকারের সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। হারাতে বসা গণতন্ত্র আবার দিশা খুঁজে পায়। তারপর থেকে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বদলে দিয়েছেন বাংলাদেশকেই। দুই দশক আগের বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশে আকাশ-পাতাল ফারাক।
বলছিলাম ১১ জানুয়ারির কথা। ঠিক ১৭ বছর পর সেই ১১ জানুয়ারিতেই রচিত হলো বাংলাদেশের রাজনীতির আরেক অধ্যায়। টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন শেখ হাসিনা, ১/১১ সরকার যাকে রাজনীতি থেকেই মাইনাস করতে চেয়েছিল। সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে যখন নতুন সরকার শপথ নিচ্ছিল, তখন ৫ মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর বাসায় ফিরেছেন বেগম খালেদা জিয়া।
সেদিন সকালে ৭৪ দিন পর তালা ভেঙে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করেন বিএনপি নেতারা। ২৮ অক্টোবর সহিংসতার পর থেকে বিএনপি তাদের অফিসে যায়নি বা যেতে পারেনি। এই ৭৪ দিন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ ছিল। বিএনপির অভিযোগ, পুলিশ তাদের অফিসে তালা দিয়ে রেখেছিল। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, তারা বিএনপি অফিসে তালা দেয়নি।
খালেদা জিয়া যে পাঁচ মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, সে সময়টা বিএনপি সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে ছিল। কিন্তু তারা আন্দোলনে সাফল্য তো পায়ইনি বরং এ সময়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতি ও সরকারে নিজেদের অবস্থান আরও সংহত করেছে। বিএনপি আরও কোণঠাসা হয়েছে। গত বছরের জুলাই থেকে বিএনপি সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন করছে। তারও আগে থেকে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে বিএনপি দেশজুড়ে ব্যাপক সন্ত্রাস চালিয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি।
উল্টো বিএনপির নামের সাথে জুড়ে যায় ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’র তকমা। লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়েছে দেখে বিএনপি সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে ফিরে আসে। ২০২২ ও ২০২৩ সালের বেশিরভাগ সময় বিএনপি দেশজুড়ে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন, লিফলেট বিতরণের মতো নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাতে তারা অনেকটা সাফল্যও পেয়েছিল। বিভিন্ন সমাবেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি রাজনীতির মূলধারায় বিএনপির অবস্থান আরও শক্ত করেছিল। কিন্তু গত বছরের ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের দিন বিএনপি তাদের আগের চেহারায় ফিরে যায়।
প্রধান বিচারপতির বাসায় হামলা, পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, অ্যাম্বুলেন্স ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ চালিয়ে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার হন। যারা গ্রেফতার এড়াতে পেরেছিলেন তারাও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। বিএনপির এক দফা আন্দোলন যখন তুঙ্গে থাকার কথা, তখনই দলটি পরিণত হয় ভার্চুয়াল সংগঠনে।
লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি কর্মসূচি আসতো। রুহুল কবির রিজভি ঢাকার কোনো গোপন জায়গা থেকে সেই কর্মসূচি পাঠ করতেন। হরতাল-অবরোধ ডাকলেও নেতাকর্মীরা মাঠে নামতেন না। এক পর্যায়ে বিএনপি সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক দিলেও তাতে কেউ সাড়া দেয়নি। এমনকি বিএনপি নেতাকর্মীরা অসহযোগে সাড়া দেয়নি। মাঠে না থাকলেও বিএনপির নেতাকর্মীরা ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে নির্বাচন ঠেকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছে।
সমস্যাটা হলো, বিএনপি তাদের আন্দোলনের সাফল্যের জন্য জনগণের ওপর নির্ভর করেনি। তারা চেয়েছিল বিদেশি শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করলে বিএনপি নতুন আশায় বুক বাধে। তারা ধরে নিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ব্যাপক তৎপরতা বিএনপির আশার পালে হাওয়া লাগায়। তখনকার বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর পিটার হাসকে ‘ভগবান, অবতার’ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু শাজাহান ওমরও ডিগবাজি দিয়ে আওয়ামী লীগের এমপি বনে গেছেন। পিটার হাসও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবনে পিটার হাসের হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি বিএনপির আন্দোলনের কফিনে শেষ পেরেক গেঁথে দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের যৌক্তিক সমালোচনা করলেও নতুন সরকারের সাথে কাজ করার অঙ্গীকারও করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে চেয়েছে। তাতে বিএনপি ধরে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পক্ষে কাজ করছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবার বলেছে, বাংলাদেশের কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে তাদের অবস্থান নয়। তারা শুধু বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত দেখতে চায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে সৃষ্ট বিভ্রমই আসলে বিএনপিকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেছে। ২০২১ সালে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ নেই। বরং পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতির প্রশংসাই করেছেন তারা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন পুরোপুরি ভালো না হলেও বাংলাদেশের মানে তা যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ ছিল। বিএনপি অংশ না নেওয়ায় ভোটার উপস্থিতি কম ছিল বটে, তবে কয়েকটি আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। নির্বাচন যে মানেরই হোক, সে নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। বিএনপি নির্বাচনও ঠেকাতে পারেনি, সরকার গঠনও আটকাতে পারেনি।
পত্রপত্রিকায় দেখছি, বিএনপি এখন নতুন করে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বিএনপিকে অবশ্যই যৌক্তিক দাবি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। সরকারের ভুল ধরিয়ে দিতে হবে। দেশ-বিদেশের দিকে না তাকিয়ে জনগণের কাছে যেতে হবে। সন্ত্রাস ভুলে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করতে হবে।
আবার টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসাকেই যেন আওয়ামী লীগ শেষ মনে না করে। দেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং বজায় রাখাটাও নিশ্চিত করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী বললো, কী ব্যবস্থা নিলো; তা নয়; আওয়ামী লীগকে দেশের জনগণের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতিতে আবার গতি ফিরিয়ে আনা, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা। আর এটা নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
বিএনপি যদি আবার নতুন করে মাঠে নামে, আবার যদি সহিংসতার পথে হাঁটে তাহলে সরকারের কাজটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে। বিএনপি নির্বাচনে না এসে ভুল করেছে। সে ভুলের মাশুল তারা দিচ্ছে, দিতে হবে আরও অনেকদিন। তবে আওয়ামী লীগ বা সরকার যেন আগের মতো বিএনপির ওপর প্রতিহিংসাপরায়ন না হয়। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী এখনও কারাগারে। তারা যাতে ন্যায়বিচার পান, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে জামিন পান; সরকারের পক্ষ থেকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
সব মিলিয়ে রাজনীতি যাতে আবার স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে পারে; তা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে দায়িত্ব সবাইকে নিতে হবে। বিএনপিকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। তবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব অনেক বেশি। নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করার পর সরকার এখন সবার সরকার। শেখ হাসিনা এখন শুধু আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টির প্রধানমন্ত্রী নন, যে ৬০ শতাংশ মানুষ ভোট দেননি শেখ হাসিনা তাদেরও প্রধানমন্ত্রী। দেশের সব মানুষের স্বার্থ, ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব শেখ হাসিনার।
সমালোচকরা যাই বলুন, গত তিন মেয়াদে শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। নির্বাচনের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, একজন নারী হিসেবে তিনি মায়ের মমতায় দেশকে, দেশের মানুষকে আগলে রাখেন। এ মমতার ছোঁয়া যেন সবাই পায়। অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে প্রধানমন্ত্রী যেন সবার প্রতি ন্যায্য আচরণ করেন।
লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।