পলাশ আহসান
স্যাঁকরার খুট খাট কামারের এক ঘা অথবা সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনলেই আমার এই দুটি প্রবাদের কথা খুব মনে হয়। কারণ নানা প্রামাণ্য দলিল ও ইতিহাস বলছে, সেদিন কোটি মানুষের মনের কথা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ইতিহাসের ঘড়ি মিলিয়ে নিয়েছিলেন সময়ের কাটা ধরে। “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রা্ম” এই আহবান আসলেই ইতিহাসের অমোঘ বিস্ফোরণ। যেন ওই সময় ওই ডাক ছাড়া, আর কোন কথা মানাতো না।
সেদিন আসলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশ সৃষ্টির প্রসব বেদনা বুঝেছিলেন। যে কারণে তিনি নেতা, তিনি বঙ্গবন্ধু, তিনি জাতির পিতা। সেই ঐতিহাসিক ক্ষণ, ১৯৭১ এর ৭ই মার্চ। সকাল থেকে সে সময়ের রেসকোর্স ময়দান ও আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বিশাল জনসমুদ্র হয়ে উঠেছিল। আর গোটা দেশ বসে ছিল রেডিওর সামনে। কারণ ততদিনে ৭ কোটি বাঙালির মনে স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে। তাই উদ্বিগ্ন সবাই। মনে প্রশ্ন, কী বলবেন তিনি? নেতাও সেদিন বুঝেছিলেন, তাঁর কথার সৃষ্টিতে বৃষ্টি হবে। মানুষের মনের অঙ্কুর স্বাধীনভাবে ডাল পালা ছড়াবে।
কিন্তু চাইলেই কী যা খুশি বলা যায়? বিশেষ করে মানুষটি যদি একটি জাতির ওই মুহূর্তের অবিসংবাদিত নেতা হন। যার সামনে উর্দী শাহির কামানের গোলা তাক করা। যার প্রতিটি আচরণ তখন টুকে রাখছে সারা বিশ্বের কোটি কোটি শত্রু মিত্র। যে মুহূর্তে তিনি গোটা পাকিস্তানের নৈতিক প্রধান হওয়ার গণরায়প্রাপ্ত অন্যদিকে একটি জাতির স্বাধীনতার ত্রাতা। তাঁর জন্যে তো সময়টা তো বিস্ফোরণোন্মুখ। এসময় কোন ভাবেই যে হটকারি বা আবেগপ্রবণ হলে চলবে না তা তিনি বুঝতেন।
সমাবেশে আসার পথে কেউ একজন বঙ্গবন্ধুকে বললেন “জনগণ কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া মানবে না” বঙ্গবন্ধু তাকে বললেন, আমি তাদের নেতা, আমি তাদের বুঝি। তাদেরকে আমার কথা বলতে দাও” সেদিন বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি ছিলেন ওই সময়ের তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, সেদিন বঙ্গবন্ধু চশমাটা ডায়াসের উপর রেখে ১৮ মিনিট ভাষণ দিয়েছিলেন। এর কোন লিখিত কাগজ ছিল না। কিন্তু কথা বলেছিলেন চূড়ান্ত হিসেবি হয়ে।
তিনি পাকিস্তানিদের চারদফা শর্ত দিলেন। বললেন, সামরিক আইন তুলে নিতে হবে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করতে হবে। বললেন, “আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।”
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো। আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত”। একসময় মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।”
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে দেয়া সেই প্রতিটি দাবিই যে ন্যায্য তা জানতো বিশ্ববাসী। তবু বঙ্গবন্ধুকে এত কথা বলতে হলো, কারণ পকিস্তানীরা তখন বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলছিল। তাই ওই মুহূর্তেই বাঙালি যা বার্তা পাওয়ার পেয়ে গেলো। তারা বুঝে গেলো সাবধানে মুক্তির চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে হবে। সামনে মুক্তিযুদ্ধ আসছেই। একই বার্তা পেলো পাকিস্তানী উর্দি শাহিও। বঙ্গবন্ধুকে তারা বিশ্ববাসীর কাছে আরও একবার বিচ্ছিন্নতাবাদী বললো বটে, কিন্তু কোন কথা দিয়ে প্রমাণ করতে পারলো না। সারা বিশ্বের বাঘা রাজনীতিকরা সেদিন অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, নিজের মধ্যে কী দুর্দান্ত পরম্পরা সৃষ্টি করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান !
বাকি ইতিহাস সবার জানা। তবু বলতে হয় বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণের পর উত্তাল হয়ে উঠেছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। ঘরের মা-বোনেরা্ও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ঘর ছেড়ে অনিশ্চয়তার উদ্দেশে বের হয়ে পড়েছিলেন যুবকের দল। উঠতি কিশোরের কণ্ঠেও বেজেছিল মুক্তির গান। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাঙালির আকাশে উঠেছিল লাল স্বাধীনতার সূর্য। বিশ্বের মানচিত্রে যুক্ত হয়েছিল বহুল কাঙ্ক্ষিত এক খণ্ড স্বাধীন বাংলাদেশ।
কিন্তু তখন্ও পাকিস্তানের কারাগারে মুক্তির ত্রাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ই মার্চের ভাষণ দেয়ার ১৯ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে আটক করেছিল আইয়ুব শাহির সশস্ত্র বাহিনী। গ্রেপ্তারের একদিন পরেই তাঁকে নেয়া হয় করাচিতে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে বলেন, শেখ মুজিব দেশের ঐক্য ও সংহতির ওপর আঘাত করেছেন, এর শাস্তি তাঁকে পেতেই হবে। ওইদিনই তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
পরে বঙ্গবন্ধুকে নেওয়া হয় লাহোরের ৮০ মাইল দূরের লায়ালপুর কারাগারে। লয়ালপুর পাকিস্তানের সবচেয়ে উষ্ণতম জায়গা। বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়েছিল একটি নিঃসঙ্গ সেলে। প্রচণ্ড গরমে প্রথমদিকে তাঁকে হাত পাখাও দেয়া হয়নি। তার চেয়ে বড় কথা তিনি কোথায় আছেন সে ব্যাপারে চূড়ান্ত গোপনীয়তা রাখে পাকিস্তান সরকার। মার্চ মাসে গ্রেপ্তারের পর জুলাই মাসে প্রথম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে খবর আসে পত্রিকায়। সেখানে জেনারেল ইয়াহিয়া বলেছিলেন ‘আজ তিনি সুস্থ আছেন, কিন্তু কাল কী হবে আমি বলতে পারছি না।’
আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারি এই অমানবিক নির্যাতনের পুরোটাই ৭ই মার্চের ভাষণের প্রতিক্রিয়া। বঙ্গবন্ধু নিজেও সাংবাদিকদের বলেছেন তাঁর ওপর নির্যাতন হবে তিনি জানতেন। তার পরেও তিনি সেদিন স্বজাতিকে মুক্তির চূড়ান্ত বার্তা দিয়েছিলেন। কারণ এটাই ছিল সময়ের দাবি। পরবর্তিতে দেশ বিদেশের রাজনৈতিক দুরদর্শীরাও তাই ভেবেছেন। যার ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণেকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর, বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের সঙ্গে তুলনা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন , চার্চিল এবং মার্টিন লুথার কিং এর আলাদা তিনটি ভাষণের। কিন্তু বিশ্লেষকরা এখনও ৭ই মার্চের ভাষণটিই এগিয়ে রেখেছেন। ওই তিন নেতাও একটি যুদ্ধাবস্থায় এমন ভাষণ দেন। কিন্তু তাদের কারো বুকে বঙ্গবন্ধুর মত কামান তাক করা ছিলো না।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।