অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন সাহসী ও স্থিতিশীল নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা

দিনকাল বাংলাদেশ

অধ্যাপক ড. মো. মোতাহার হোসেন

 

বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নমুখী রূপান্তরের বাস্তব উদাহরণ। তার নজড়কাড়া সাহসী পদচারণায় বিস্মিত বিশ্ব সমাজ। যে দেশটি এক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্ষুধা-মঙ্গা, সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য পরিচিত ছিল, হেনরি কিসিঞ্জার যেদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়েছিলো, সে দেশটি আজ বিশ্বের অন্যতম সেরা অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্প-গাঁথায় ঠাই করে নিয়েছে।

 

তাইতো অসংখ্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন উপাখ্যানকে এশিয়ার তথা বিশ্বের সেরা বলতে দ্বিধা করে না। বিশ্ববিখ্যাত রেটিং সংস্থাগুলোও বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত ইতিবাচক রেটিংয়ে স্থান দিয়ে আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত প্রদান করছে।

 

সমসাময়িক বিশ্বের শ্লথ গতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিপরীতে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি চিত্তাকর্ষক প্রবৃদ্ধি উপহার দিয়ে যাচ্ছে, যা অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। বৈশ্বিক মহামারির পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী বছরগুলোতে দেশটি ধারাবাহিকভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার প্রদর্শন করেছে। এই সময় বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৪ শতাংশ।

 

একক বছর হিসেবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা পৌঁছায় সর্বোচ্চ ৮.২ শতাংশে। তবে কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি নেমে আসে ৩.৪ শতাংশে। এসময়ে বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক, প্রতিবেশী কিছু দেশের অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। সংকট মোকাবেলায় সরকারের নেওয়া বিভিন্ন আর্থিক নীতি ও উদ্দীপনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার আবার ৬.৯ শতাংশে ফিরে আসে।

 

২০২১-২২ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ৭.২৫ শতাংশে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটি হয় ৬.০৩ শতাংশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ অর্থনৈতিক আবহে ৬ শতাংশের উপর প্রবৃদ্ধি অনেক দেশের কাছে কল্পনাতীত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নেয়া শিল্প ও পরিষেবা খ্যাতে ব্যাপক নীতিসহায়তা ও প্রণোদনার কারণে এ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।

 

তাইতো, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অর্জন করে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার অর্জন করে যা পূর্বতন বছর থেকে ৩৪.৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য এবং পরিষেবা রপ্তানির মাধ্যমে ৬৪.৫৫ বিলিয়ন ডলার অর্জিত হয়েছে।

 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৬.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৯ সালে তা ১০০ বিলিয়নে এবং ২০২৩ সালে ৪১৬.৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। জিডিপির আকার অনুযায়ী ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ অবস্থান ছিল ৬০ তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে এবং ২০২৩ সালে ২৫ ধাপ এগিয়ে এখন বিশ্বের ৩৫ তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে।

 

অর্থনৈতিক অগ্রগতির এধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ২৪ তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, ২০১৫ সালের পহেলা জানুয়ারি বিশ্বব্যাংকের মান অনুযায়ী বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং ২০২১ সালের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে।

যদিও ২০২১ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ২৪ নভেম্বর ২০২৬-এ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে আনুষ্ঠানিকভাবে বের হয়ে আসবে। এই অর্জনটি আসছে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রায় ৫০ বছর পর। দেশে ব্যাপক বিনিয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ডিজিটাইজেশন এবং উচ্চ রপ্তানি প্রবৃদ্ধির স্বার্থে আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত নীতি এ সাফল্যের মূল কারণ।

 

শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারেই নয় আর্থসামাজিক অগ্রগতিসহ সকল মৌলিক সূচকেই আওয়ামী লীগ সরকারের এ সাফল্য দৃশ্যমান। গত দেড় দশকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২ কোটি ৩৫ হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২.৭ শতাংশ।

মাথাপিছু আয় ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৬৮৬ মার্কিন ডলার থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ গুন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ মার্কিন ডলার। ২০০৮ সালে গড় আয়ু ৬৬.৮ থেকে বেড়ে ২০২১ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে ৭২.৩ বছর।

 

দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১.৫ শতাংশ হতে অর্ধেকেরও বেশি হ্রাস পেয়ে ২০২২ সালে তা ১৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে চরম দারিদ্র্যতার হার তিন-চতুর্থাংশ কমে ২৫.১ শতাংশ থেকে ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

 

২০০৯-১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট, ২০২২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াটে।

 

প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে বাংলাদেশের শতভাগ জনসংখ্যাকে বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাস, সৌর ও বায়ুর মত বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে বাংলাদেশ পারমানবিক শক্তি উৎপাদনকারী দেশগুলোর অভিজাত ক্লাবে যোগ দিবে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য একান্ত প্রয়োজন।

 

তাইতো বাংলাদেশ দ্রুত এশিয়ান টাইগার হয়ে ওঠছে। দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের গৃহীত সুদূরপ্রসারী কার্যকর নীতিই বাংলাদেশের উন্নয়নে মূল ক্রীড়নকের ভূমিকায় রয়েছে। প্রতিবেশী এবং অনুরূপ দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এ ঈর্ষণীয় সাফল্য বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে।

 

এত সাফল্যের মাঝেও একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির এই অগ্রগতির পথ মোটেও মসৃণ নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বৈশ্বিক কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনীতি যখন কোভিড-১৯ জনিত বৈশ্বিক মহামারির করাল থাবা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছে, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটি বড় ধাক্কা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বইছে সীমাহীন অনিশ্চয়তা ও দুর্ভাবনার পাগলা হাওয়া।

 

বাংলাদেশও এর বাইরে নেই। বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনের সমস্যায় আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ, মন্থর হয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ডলারের উচ্চমান এবং ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয় এখন অর্থনীতির জন্য বড় চিন্তার বিষয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি চাপে রেখেছে মানুষের স্বাভাবিক ক্রয় ক্ষমতাকে।

 

বিশ্বব্যাপী শ্রমবাজারের মন্দা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকেও প্রভাবিত করছে। বৈশ্বিক এই সমস্যা মোকাবেলা করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সার্বিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখাই এখন সরকারের প্রধান লক্ষ্য। তাইতো বাংলাদেশের অর্থনীতি চলমান এই সংকট ভালোভাবেই সামাল দিয়ে জোর কদমে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সর্বশেষ আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থনৈতিক পূর্বাভাসেও এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ মেলে।

 

বৈশ্বিক এই সংকটের মাঝে, আগামী ৭ই জানুয়ারি ২০২৪ শুরু হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, আসন্ন নবগঠিত সরকার তার মেয়াদের শুরু থেকেই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সমস্যার প্রেক্ষিতে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা, বড় অবকাঠামো সমূহের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ করা, বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল রাখা, পর্যাপ্ত তারল্য নিশ্চিত করা এবং রাজস্ব ভিত্তি প্রসারিত করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনা সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে আরও এগিয়ে নিতে হবে।

 

অতীতের বিভিন্ন সরকারের কর্মদক্ষতা এবং অবদান তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মত দক্ষ, ভিশনারী ও সাহসী নেতৃত্ব আগামী দিনের জন্য আরও বেশি করে প্রয়োজন। একমাত্র, তিনিই পারেন তলাবিহীন ঝুড়িকে উন্নয়নের রোল মডেলে রূপান্তরিত করতে, যা তিনি করে দেখিয়েছেন।

 

অর্থনীতিবিদদের ভাষায় তাইতো তিনি দুর্দান্ত পারফর্মার। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে প্রচুর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সম্মান ও গুরুত্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। তাইতো বাংলাদেশ আজ বিস্তৃত ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনার সুদক্ষ এবং উন্নয়নমুখী নেতৃত্বে শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয় সারা বিশ্বে বাংলাদেশ আজ একটি অপার সম্ভাবনাময় দেশ।

 

এই ভাবনা থেকেই বলা যায় বাংলাদেশের মানুষ আবারও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবে এবং শেখ হাসিনার স্থিতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি তার অস্থির সময় পার করে এশিয়ার এমার্জি টাইগার রূপে আত্মপ্রকাশ করবে।

 

 

লেখক: অধ্যাপক, পরিচালক, আইকিউএসি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *