যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যে সফর শেষে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী জনদুর্ভোগ এড়াতে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা বাতিল

দিনকাল বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ১৬ দিনের সরকারি সফর শেষ করে দেশে পৌঁছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট (বিজি-২০৮) হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার সময় বিমানবন্দর থেকে গণভবন পর্যন্ত তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল আওয়ামী লীগ। তবে তাতে সম্মতি দেননি প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, নেতা-কর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী তাতে রাজি হননি।

 

জনগণের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে সংবর্ধনা না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন রাজধানীবাসী। তারা বলছেন, এমনিতেই ঢাকায় যানজটের মধ্যে চলাচল করতে হয়। এরপর কোন সমাবেশ বা সংবর্ধনা থাকলে সেইদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় বসে থাকতে হয়্ এমন পরিস্থিতিতে সরকারপ্রধান বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ায় তারা খুশি। বৃষ্টি এবং কর্মদিবস হওয়ার পরেও বুধবার ঢাকার রাস্তা তুলনামূলক ফাঁকা ছিলো। মিরপুর থেকে মতিঝিল অফিস করেন সাকিলা জাহান। তিনি আজকে যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে পারেন ভেবে রাস্তায় বের হয়েছিলেন। বিজয় স্মরণির সিগন্যালে অপেক্ষমান অবস্থায় তিনি বলেন, ‘আমার খুব ভালো লেগেছে শেখ হাসিনা এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। আমরা সাধারণত এমন নজির কম দেখতে পাই। তার জনগণ রাস্তায় কষ্ট পাক এটা তিনি চাইবেন না এটাই স্বাভাবিক।’

 

বেলা ১২টা থেকে একটা ঢাকা বিভিন্ন রাস্তায় চলাচল করে দেখো গেছে অন্যদিনের থেকে রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক ছিলো। ঢাকায় বিভিন্ন রাস্তা যদি না আটকানো হয় তাহলে জনমনে কিছু স্বস্তি থাকে উল্লেখ করে বাসচালক রবিউল বলেন, আজকে ফাঁকা আছে রাস্তা। পথে তেমন কোথাও অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে ঢাকায় এতো হয়রানি হওয়ার কথা না।

 

গত ১৭ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে রওনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার সকালে দেশে ফিরছেন প্রধানমন্ত্রী। এবারের সফরে প্রধানমন্ত্রীর অর্জন অনেক। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন ছাড়াও ৬ টি আন্তর্জাতিক ফোরামে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনেকগুলো দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। বিভিন্ন ফোরামে কথা বলেন বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে। শুধু বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার নেতা নয়, গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বের আসনে এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

কমিউনিটি ক্লিনিকের বিশ্বস্বীকৃতি অর্জন এবং এ মডেলকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে বিষয়ে ‘শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ অফ কমিউনিটি ক্লিনিক’ বিষয়ক হাইলেভেল সভায় প্রধানমন্ত্রীর ভূঁয়সী প্রশংসা করেন বিশ্বনেতারা। বিশ্বের নারী নেতাদের সংগঠন ইউএনজিএ প্ল্যাটফর্ম অব উইমেন লিডারদের বার্ষিক সভায় জাতিসংঘ মহাসচিব পদে নারী নেতৃত্ব দেখার আকাঙক্ষা সাড়া ফেলে। জলবায়ু ন্যায্যতা বিষয়ক সভায় প্রধানমন্ত্রী গ্লোবাল সাউথকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা জানান। উল্লেখ্য জাতিসংঘের জলবায় সম্মেলনগুলোতে এলডিসি’র নেতৃত্ব দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। এবারে বিবিএনজে চুক্তিতেও স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রী। যোগ দেন ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ বিষয়ক সম্মেলনে। উজরা জেয়ার সাথে সাক্ষাতে রোহিঙ্গাদের জন্য ১২০ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। রোহিঙ্গা বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনেরও আয়োজন করে বাংলাদেশ। ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সম্মেলনে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর বাইরে গণমাধ্যমে এবং সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

এই সফরে ১৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক (ডিজি) টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসিসের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হু মহাপরিচালক সকলের জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।

 

১৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে ইউএনজিএ’র ৭৮তম অধিবেশনের সাইডলাইনে ‘শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ অফ কমিউনিটি ক্লিনিক : ইনোভেটিভ এপ্রোচ এচিভিং ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ ইনক্লুসিভ অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ডিজঅ্যাবিলিটি’ শীর্ষক উচ্চ-স্তরের সাইড-ইভেন্টের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বক্তৃতা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি বলেন, কমিউনিটি ভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের চাবিকাঠি। একই দিনে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি রনিল বিক্রমাসিংহে, তিমুর-লেস্তের রাষ্ট্রপতি ড. হোসে রামোস হোর্তা ও ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করন। এদিন আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসি শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ওপর জোর দেন এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ও অপ্রসারণে বাংলাদেশের অটল অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।

 

দিনশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) থিম্যাটিক অ্যাম্বাসেডর সায়মা ওয়াজেদ এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। ভোজসভায় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।

 

২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দফতরের সম্মেলন কক্ষে মহামারী প্রতিরোধ, প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া (পিপিপিআর) বিষয়ে ৭৮তম ইউএনজিএ উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরে মহামারী প্রতিরোধের অংশ হিসেবে একটি বৈশ্বিক সহযোগিতা কাঠামো গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। একই দিনে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রতিনিধিরুমে ইউএনজিএ প্ল্যাটফর্ম অব উইমেন লিডারদের বার্ষিক সভায় বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বক্তৃতায় তিনি বলেন, “আমাদের কর্মকান্ডকে অংশগ্রহণ থেকে নেতৃত্বে উন্নীত করতে হবে এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে অবশ্যই উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। এটা দুঃখজনক যে জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে এখন পর্যন্ত কোনো নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সময় এসেছে, আমরা শিগগিরই একজনকে পাবো।”

 

একই দিনে ইসিওএসওসি চেম্বারে ‘জলবায়ু ন্যায্যতা প্রদান: ত্বরান্বিত উচ্চাকাক্ষা এবং অভিযোজন ও সবার জন্য প্রাথমিক সতর্কবার্তা বাস্তবায়ন’ শীর্ষক জলবায়ু উচ্চাকাঙ্ক্ষা শীর্ষ সম্মেলনের উচ্চ স্তরের বিষয়ভিত্তিক অধিবেশনে বক্তৃতা করেন তিনি। বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আসন্ন সংকট এড়াতে বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, “আমরা আশা করি বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং আসন্ন সংকট এড়াতে তাদের ন্যায্য অংশীদারীত্বের বিষয়ে সৎ থাকবে।”

 

একই দিনে জাতিসংঘ সদর দফতরের দ্বিপাক্ষিক বুথে মা, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য অংশীদারিত্বের (পিএমএনসিএইচ) চেয়ার হেলেন ক্লার্কের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জলবায়ু সংকট থেকে উদ্ভূত সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ’ বিষয়ে এসডিজি-৩ সহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসমূহ (এসডিজি) বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

 

২১ সেপ্টেম্বর, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরের সম্মেলন কক্ষে ‘ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি)’ বিষয়ক ইউএনজিএ উচ্চ-স্তরের বৈঠকে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক, নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল উজরা জেয়া প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বৈঠকে উজরা জেয়া প্রধানমন্ত্রীকে জানান, তারা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য ১১৬ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জেয়া রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবিকা নিশ্চিত করতে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন।

 

একই দিনে বাংলাদেশ, কানাডা, গাম্বিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সদর দপ্তরে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ‘তারা কি আমাদের ভুলে গেছে?’ শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের এক ইভেন্ট আয়োজন করে। ইভেন্টটি সঞ্চালনা করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের কাছে চারটি প্রস্তাব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে উদ্ভূত এই (রোহিঙ্গা) সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আরো বহুগুণ বাড়াতে হবে, সব বিকল্পের মধ্যে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনই সবচেয়ে কার্যকর।’

 

২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ জাতিসংঘ সদর দফতরের জেনারেল অ্যাসেম্বলি হলে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৮তম অধিবেশনে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করে মানবজাতির কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সকলকে একযোগে কাজ করার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহবান জানান।

 

২৩ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক মেট্রাপলিটন আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে ইনশাআল্লাহ। শেখ হাসিনা প্রশ্ন রাখেন, বিএনপি কী আসলেই নির্বাচন চায়? তাদের নেতা কে? তারা ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোট পায়নি এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেনি। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির উদ্দেশে নিউইয়র্ক ত্যাগ করেন। পরে লন্ডনে বাংলাদেশিদের নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধান অতিথির ভাষন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *