বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর আইএমএফ ঋণের সম্ভাব্য প্রভাব

দিনকাল বাংলাদেশ

. প্রণব কুমার পাণ্ডে

এই নিবন্ধটি রচনার শুরুতে আমি একটি বিষয় পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করতে চাই যে আমি পেশায় একজন অর্থনীতিবিদ নই। তবে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্রমহ্রাসমান প্রবণতা এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আইএমএফ ঋণের সম্ভাব্য প্রভাবকে ঘিরে চলমান আলোচনায় লোক প্রশাসনের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার উপলব্ধিতি এই নিবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা এবং বৈদেশিক রিজার্ভ বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের অংশ হিসেবে  বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (এইএমএফ) থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমান ঋণ পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই আর্থিক অন্তর্ভুক্তি দেশের জন্য অনেক ইতিবাচক প্রভাবের সূচনা করবে একথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় কারন এই ঋণ দেশ বর্তমানে যে আর্থিক চাপের মধ্যে রয়েছে তা কমাতে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক চাপের কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ কমে যাচ্ছে তা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে সমালোচনা করা হচ্ছে। এই অবস্থায় এইএমএফ এর সহায়তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় লাইফলাইন বলে গণ্য হবে। এই ঋণ সহায়তা শুধুমাত্র দেশের আর্থিক অবস্থাকে শক্তিশালী করবে না, বরং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও শক্তিশালী করবে।

বাংলাদেশকে এইএমএফ এর আর্থিক সহায়তা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসেছে যখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অর্থনীতি সমস্যা মোকাবিলা করতে এইএমএফ সহায়তা চেয়ে পাচ্ছে না। ফলে এই ঋণ সুবিধা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রেরণা প্রদান করবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এইএমএফ  ঋণের ইতিবাচক প্রভাবের কিছু মূল দিক উল্লেখ করা হল।

আইএমএফ ঋণের সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং আপাত সুবিধাগুলোর একটি হলো বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর এই ঋণের ইতিবাচক প্রভাব। এই বর্ধিত রিজার্ভ আমদানির প্রয়োজনীয়তা মেটাতে, বৈদেশিক ঋণের কিস্তি প্রদান করতে এবং অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবিলার জন্য অপরিহার্য। আইএমএফ ঋণ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় দেশের ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী করবে।

এই ঋণ সহায়তা দেশে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার পরিবেশ তৈরি করবে। এই সহায়তা বাংলাদেশকে আরও আকর্ষণীয় বিনিয়োগের কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং প্রতিশ্রুতিশীল কাজের সুযোগ তৈরি করবে। বিশ্ব যখন কোভিড-১৯ অতিমারি এবং রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের চলমান প্রভাব মোকাবিলা করছে, আইএমএফ ঋণ এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরণের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান করতে সহায়তা করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ফলে, এটা স্পষ্ট করে বলা যায় যে এইএমএফ ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বহুমুখী ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে যা তাৎক্ষণিক আর্থিক সমস্যা মোকাবিলা করতে সরকারকে সহায়তা করবে।

এইএমএফ ঋণ দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতার মুখে একটি স্থিতিশীল শক্তি হিসাবে কাজ করবে। এটি অর্থ প্রদানের ভারসাম্য সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করবে এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন, মুদ্রাস্ফীতি এবং আর্থিক অস্থিতিশীলতার সম্ভাবনা হ্রাস করবে। এই স্থিতিশীলতা বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য মৌলিক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের স্থান নির্বাচন করার সময় সময় প্রায়ই শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাসহ গন্তব্যগুলিকে অগ্রাধিকার প্রদান করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আইএমএফ এর সাম্প্রতিক ঋণ প্রদান একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে শক্তিশালী করবে এবং রাজস্ব দায়িত্বের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নকে তরান্বিত করবে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সঞ্চারিত এই নতুন আস্থা বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহকে শুধু পুনরুজ্জীবিতই করবে না, বরং এটিকে বিদেশী সরাসরি  বিনিয়োগের (এফডিআই) জন্য আরও প্রলোভনশীল কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। দেশে এফডিআই এর প্রবাহ বেশি হলে তা কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সহায়তা করবে যা বেকারত্ব হ্রাস এবং জনগণের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য অপরিহার্য। তাছাড়া, বিদেশী বিনিয়োগ প্রায়শই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং শিল্পের সর্বোত্তম অনুশীলনের সাথে সংযুক্ত, যা দেশের শিল্প ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করবে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অবদান রাখবে। আইএমএফ ঋণ এবং বিদেশী বিনিয়োগের মধ্যে এই সমন্বয় আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

এইএমএফ ঋণ সহায়তা একটি দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নীতিগত শর্তগুলির একটি সেট নিয়ে আসে। এই সংস্কারগুলি সরকারী ব্যয় অপ্টিমাইজ করতে, শাসন ব্যবস্থার উন্নতি এবং ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। আইএমএফ চুক্তির অংশ হিসেবে, বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করবে এমন কাঠামোগত সংস্কার গ্রহণে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার কারণে এক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা যায়।

কোভিড-১৯ অতিমারি পরবর্তী রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধ প্রভাব দ্বারা সৃষ্ট আর্থিক চ্যালেঞ্জগুলি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করে চলেছে। ফলে, এই প্রেক্ষিতে, এইএমএফ ঋণ শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণে সহায়তাই করবে না, বরং চলমান অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টাকে সহজতর করবে। অতিমারি দ্বারা সৃষ্ট আর্থ-সামাজিক সমস্যা থেকে দেশকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে এই ঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।

পরিশেষে বলা যায় যে এইএমএফ এর ঋণ নিয়ে বিভিন্ন সমালচনা থাকলেও বাংলাদেশের জন্য এই ঋণ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। এই ঋণ বৈদেশিক রিজার্ভ সংক্রান্ত শঙ্কা কাটিয়ে উঠতে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা জাগ্রত করতে, প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সংস্কার নিশ্চিত করতে এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলার করতে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করবে।  বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে, এই আর্থিক সহায়তা দেশের অর্থনৈতিক গতিপথ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *